“শেষের রাত্রি ”গল্পটি লিখেছেন কলমযোদ্ধা আবির হাসান সায়েম।

544
“শেষের রাত্রি ”গল্পটি লিখেছেন কলমযোদ্ধা আবির হাসান সায়েম।

শেষের রাত্রি

আবির হাসান সায়েম

লেকের আশেপাশে কোন মানুষ নেই।এমন সময় কারোর থাকার কথাও না। এর উপর আবার অনবরত বৃষ্টি পরেই যাচ্ছে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে। হাতে ঘড়ি নেই। সময়টা জানা দরকার। ভোর কি হয়েছে? এতোক্ষণে তো আযান দিয়ে দেয়ার কথা। এইখান থেকে কি আযান শুনা যায় না? কোন মানুষ নেই আশেপাশে নাহলে কাওকে জিজ্ঞেস করা যেতো মসজিদটা কোন দিকে। ফযরের নামায পড়তে হবে।
নামাযের কোন নিয়ম কি মনে আছে? ওযু কিভাবে করতে হয় তা মনে আছে। সূরা কি কি মনে আছে। শায়ান সূরা মনে করার চেষ্টা করল। সূরা ফাতেহা আর সূরা ইখলাস মনে আছে। ছোটবেলায় শায়ান ঘুমানোর আগে প্রতিদিন সুরা ফাতেহা একবার আর সুরা ইখলাস তিনবার পড়ে বুকে ফু দিতো। তার দাদী একবার বলেছিলেন,
“একবার সূরা ফাতেহা আর তিনবার সূরা ইখলাস পইড়া বুকে ফু দিলে শয়তান আশেপাশে আর আহে না। ”
এই দুইটা সূরা দিয়ে কি নামায হবে? হ্যা হয়তো হবে। ২০ বছর অর আবার নামায পড়ছে সৃষ্টিকর্তা হয়তো প্রথমবার হিসেবে কবুল করে নিতেও পারেন।
শায়ান হাটছে লেকের পাশের সরু পথ দিয়ে। শার্টটা ভিজে গায়ের সাথে লেগে গেছে। শায়ান অনুভব করতে পারছে, গরম পানির ফোটা তার গাল বেয়ে নীচে গড়িয়ে পরছে। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি আর চোখের গরম পানি মিলে একটা অদ্ভুত জিনিস হয়েছে। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই, শায়ানের ইচ্ছে করছে খুব চিৎকার করে কাদতে। কিন্তু সে পারছে না। কিছু কিছু সময় মানুষের ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাদতে। চিৎকারের প্রখরতা এতো বেশি হবে যেনো প্রকৃতিও তা শুনে হিমশিম খেয়ে যায়।কিন্তু মানুষ তা চাইলেও করতে পারে না। কোনো এক মাধ্যম তাকে করতে দেয় না । এই অজানা মাধ্যমের কথা জানলে হয়তো পৃথিবী অধিকাংশ রহস্যভেদ করা যেতো।

গতকাল রাত,

দশটার মতো বাজে। শায়ান বসে আছে ড্রয়িংরুমে সোফায়। সোফার সামনে বিশাল বারান্দা। ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে ঘ্রাণ আসছে। বৃষ্টি হওয়ার আগে যেমন ঘ্রাণ পাওয়া যায় সেরকম ঘ্রাণ। শায়ান সোফার শরীরটা এলিয়ে দিলো। ঘুমে চোখ লেগে আসছে। আজ খুব ভালো ঘুম হবে।
এগারোটার দিকে, এক বিকট চিৎকারে শায়ানের ঘুম ভেঙে গেলো। তার শোবার ঘর থেকে শব্দ আসছে৷ শায়ান ধড়ফড় করে উঠে দৌড়ে গেলো শোবার ঘরে৷ বিছানার পাশে শ্যামলী পরে আছে। রক্তে তার শাড়ি ভিজে গেছে ৷ আরেকবার চিৎকাত দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো শ্যামলী। শায়ান শ্যামলীকে কোলে করে নীভে নামাল। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই। আসাদ সাহেব বাড়ি ফিরছিলেন। গাড়ির ভিতর থেকেই দেখলেন, শায়ান শ্যামলীকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে আছে। আসাদ সাহেব ডাক দিলেন,
“শায়ান সাহেব এই দিকে আসুন। ”
শায়ান ছুটে গেলো গাড়ির দিকে। অস্পষ্ট গলায় বলল,
” ভাই একটু হাস্পাতালে নামিয়ে দিবেন প্লিজ? ”
“উঠে বসুন। কি হয়েছে ভাবীর?”
“জানি না। ভাই তাড়াতাড়ি চলুন।”
তারা প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে হাস্পাতালে পৌছে গেলো।
ডাক্টার রকুনুজ্জামান নাড়ি দেখলেন এরপর টেস্টের রিপোর্ট হয়তো ভালো আসে নি। ডাক্তার সাহেবকে বেশ শনকিত মনে হচ্ছে। শায়ান জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে স্যার? ”
“এখনি অপারেশন করতে হবে। ”
“কিন্তু স্যার ডেলিভারির ডেট তো আরো তিনমাস পরে। ”
” বাচ্চার মাথা উপরের দিকে আর সিনক্রোনাইজড জরায়ুর প্লাজমা হতে দূরে সরে গেছে। আর পেসেন্টের শরীর থেকেও প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে।”
“স্যার আমি কি অপারেশন থিয়েটারে আপনাদের সাথে থাকতে পারি?”
ডাক্তার সাহেব গম্ভীর গলায় বললন,
“হ্যা পারেন।”

শায়ান শ্যামলীর হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। ডাক্তার রকুনুজ্জামনের সাথে তিনজন নার্স আর একজন মহিলা ডাক্তার অপারেশন করছেন। শ্যামলীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বড্ড মায়া লাগছে দেখতে।
হঠাৎ ডাক্তারদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হলো। ডাক্তার রকুনিজ্জামানের কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। শায়ান জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে স্যার?”
“অবস্থা খারাপের দিকে। আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। ”
শায়ান ঘোর নাস্তিক ধরনের লোক। গত বিশ বছর ধরে সে আল্লাহ নাম একবারো মুখে এনেছে কি না কে জানে। তার ধারণা মানুষকে বা প্রকৃতিকে কেওই সৃষ্টি করে নি। সাধারণ জৈব বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের বিকাশ হয়েছে। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টিকর্তা নামক একটা জিনিস তৈরী করেছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন,
“ভাই বাচ্চার পা প্লেসেন্টারের সাথে জরিয়ে গেছে। বলা যায় না যে কোন কিছু হতে পারে।সাহস রাখেন। আল্লাহকে স্মরণ করেন।”
শায়ানের বুকে হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগল। সৃষ্টিকর্তা বলে হয়তো আসলেই কেও আছেন। মানুষ যখন অসহায় হয়ে যায়, কারো কাছে যাওয়ার থাকে না তখন শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছেই সাহায্য চাওয়া যায়। সৃষ্টিকর্তাই পারে যেকোন বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।
ডাক্তার সাহেব একটা জীব কে বের করে আনলেন। ডাক্তার সাহেবের হাতের তালুর চাইতেও ছোট। চোখগুলো তেমন ফোটে নি। নাকটা একেবারে ছোট৷ কয়েকবার নাড়াচাড়া করে এই অদ্ভুত দেখতে জীবটা নিস্তেজ হয়ে গেলো৷ এই বিশাল পৃথিবীর এতোটুকু আলো বাতাসই তার জন্য বরাদ্দ ছিলো।

কাছে কীথাও থেকে আযানের ধবনি ভেসে আসছে। বৃষ্টি অনেকটাই কমে গেছে। কিছুক্ষন পরপর জোরে বাতাস বইছে। বাতাসে লেকের পানিতেও নদীর মতো ঢেউ হচ্ছে।
“কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত। “

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here