ঠিকানা
-নাসরিন আক্তার
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, বিকেল বিকেল ঠাণ্ডা পরে যায়। স্থিতিহীন জীবনেও মিষ্টি রোদের উষ্ণতা পেতে বারান্দায় এসে বসেন নাজমা বেগম । ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে একমনে তাকিয়ে থাকেন হালকা বাতাসে তিরতির করে ঝরে পড়া বয়সি পাতাটি দিকে । বারান্দায় বসা নাজমা বেগম পাতা ঝরার দৃশ্যটি দেখতে দেখতে ঝরা পাতার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন জীবনের ধারাপাত।
আজ এই আপন নিবাস থেকেও ঝরে পড়লো একটি পাতা, হলুদ পাতা। কোন এক মধ্যদুপুরে শীর্ণকায় ষাটোর্ধ সাজেদা বানু ব্যাগ হাতে এসে বলেন- আমার জন্য একটু জায়গা হবে?
সেই থেকে তিনি এই আশ্রমেই ছিলেন। আশ্রম আর নিবাসে কি পার্থক্য? জানা নেই…
কোনদিন কাউকে ওনার সাথে দেখা করতে আসতে দেখা যায়নি। নিজের ঠিকানাটাও ঠিকমত নিবন্ধন করেননি এই স্বল্পভাষিনী সাজেদা বানু, তাই আজ তাঁর লাশেরও কোন ওয়ারিশান ছিলো না।
শূন্যস্থান কখনো শূন্য থাকে না। আর কিছু না হলেও বাতাস এসে পূর্ণ করে দেয়। ঠিক সেরকমই সাজেদা বানুর শূন্যস্থানও কেউ না কেউ এসে পূর্ন করে নিবে, তাই লাশ বের করে নেওয়ার পর থেকেই চলছে ঝাড়ামোছা।
দেখতে দেখতে নাজমা বেগমের জরামনে মৃত্যু ভাবনা ঐ ঝরা পাতাটার মতই তিরতির করে কাঁপে। হাটুর ব্যথাটা খুব বেড়েছে, তাই চাইলেই চট করে উঠে দাঁড়াতে পারেন না- সাপোর্ট হিসেবে লাঠি ধরতে হয়।
লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান নাজমা বেগম। মৃত্যু ভয় নাকি আবসাদে- খুব ক্লান্ত লাগে। নিজের রুমে ফিরতে যাবেন ঠিক তখনি চোখ পড়ে লাল রঙের ডাইরীটার দিকে। ডায়েরীটা পরে আছে সিঁড়ির একদম নিচের ধাঁপের এক কোনে।
মনে মনে বলেন, এটা সাজেদা বুবুর ডায়েরী না!? জিনিসপত্র সরানোর সময় পরে গিয়ে থাকবে। নাজমা বেগম ডায়েরীটা তুলে নিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসেন, উল্টেপাল্টে দেখেন। সারাদিন এই ডায়েরীতে কি এত লিখতেন সাজেদা বানু? অনেক দিন ভেবেছে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু বিবেক সায় দেয়নি কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে। বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর থেকেই লক্ষ্য করেছেণ, সাজেদাবানু প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলেন না। সারাদিন ঐ ডায়েরীটা আকড়ে পড়ে থাকেন।
যতই ডায়েরীটা নাড়াচাড়া করে ততোই ওটার ভিতরের গল্প জানতে মনে ঢেউ তোলে । পা তুলে খাটের কোনায় বসেন নাজমা বেগম। শাড়ির আঁচলে পুরনো ফ্রেমে মোড়ানো চশমাটা মুছে স্বচ্ছ করে নেন।
এবার ডায়েরীর মলাট উল্টান- গোটা গোটা অক্ষরে পাতার পর পাতা লিখে গিয়েছেন সাজেদা বানু…
——-আমি সাজেদা বানু। অনার্স – মাস্টার্স, হাইস্কুলের প্রাত্তন সিনিয়র শিক্ষিকা। উচ্চ শিক্ষিত তিন সন্তানের জননী হয়েও জীবনের উচ্ছ্বল সময়টুকু যে সংসার নামক বৃক্ষকে আলো, বাতাস, পানি দিয়ে সজিব করে তুলেছি, আজ নিজেই সেখানে বয়সি পাতার মতো পরিত্যাক্ত জঞ্জাল। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কগুলো কেমন বায়বীয় হয়ে গেছে। আজ সবাই সার্থের চাঁদর মুড়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। আমার অলস মূহুর্তগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে সাপের মত জড়িয়ে ধরে।
একটা সময় লক্ষ্য করলাম সম্পর্কের মুখগুলো বড় গম্ভীর আর অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তিলতিল করে সংসার মঞ্চে যে ভাষ্কর্যগুলো তৈরী করেছি, যার সর্বত্র আজও মিশে আছে আঙ্গুলের ছাপ অথচ তার কোথাও আর নিজেকে খুঁজে পাই না।
বুঝতে পারলাম এদের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন একসাথে বসবাস শুধুই বিরম্বনা বাড়ানো। আমি নারী তাই সব জায়গাতেই আমি আলগোছে পড়ে থাকা পুরানো আসবাবের মত! কোথাও নিজস্ব জায়গা নেই আমার।
নারীর পরম আপনজন তার স্বামী। সংসারে যার স্বামী নেই তার আবার সংসার থাকে নাকি?!
আর সন্তান?! নিষ্প্রয়োজন…
সন্তান কখনো আপন হয় না। ফল পেকে গেলে যেভাবে গাছ থেকে ঝড়ে পরে, শুয়োপোকার পাখা গজালে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায় সন্তানও তেমনি বড় হলে পর হয়ে যায়…
এটা নিয়ে যে আক্ষেপ করে সে নিতান্তই বোকা, আমি সে দলের নই।
নিজের রোজগারে সংসার সাজিয়েছি, এতদিন এটা আমার কর্তব্যের মাঝেই ছিলো। নিজে যা আয় করেছি, ওদের বাবার পাশাপাশি সংসারে ঢেলেছি, সন্তানদের ভালো স্কুল কলেজে পড়ানো, ভালোভাবে মানুষ করতেই সবটা শেষ করে আজ আমি নিঃস্ব।
আমার ঘর নেই- বেশির ভাগ মেয়েরই ঘর থাকে না। ছেলেবেলায় খুব ইচ্ছে হতো আমার একটা ঘর থাকবে, নিজেস্ব একটা কামরা, প্রাইভেসি, আমি নিজের মত করে সাজাবো, থাকবো।
মাকে বলতাম, কবে আমার একটা ঘর হবে?
ছোট চাকুরীজীবী বাবার পক্ষে অনেক কামরার বাসা ভাড়া করা সম্ভব ছিলোনা তাই আমরা ছয় ভাইবোন মিলে দুই কামরার বাসায় থাকতাম। আমাদের কোন প্রাইভেসি ছিলো না। ভাইবোনে মিলে হুটোপুটি, মারামারি আর সকাল সন্ধ্যা এক টেবিলে গাদাগাধি করে সুর তুলে পড়া।
মা বলতেন- বিয়ে হলে ঘর পাবি, সেটাই মেয়েদের নিজের ঘর। সত্যিই কি তাই?! মেয়েদের ঘর হয়?! একসাথে বাস করতে গেলে ঠোকাঠুকি লাগেই আর আমি ছিলাম অনেকটাই স্বাধীনচেতা, কারো কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া কঠিন।
একদিন তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে স্বামী কর্তার মুখ থেকে শুনতে হলো- যাও, ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।
“আমার ঘরে থাকতে হলে আমার কথা মেনেই থাকতে হবে, এটা আমার সংসার। আমার সংসারে আর কারো কোন কথা চলবে না।”
তাহলে আমি কে?! কোথায় আমার সংসার?! আমার ঘর?!
যে সংসারে নিজেকে কর্পূরের মত নিঃশেষ করেছি সেটা আমার নয়?!
হায় ঘর, হায় সংসার!
তবুও স্বামীর সংসারে কিছুটা হলেও অধিকার বোধ থেকে যায়, গলা উচু করে বলা যায়, তর্ক করা যায় নিজের অধিকার নিয়ে, যুদ্ধ করা যায়।
একদিন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে স্বামী চলে গলেন। ধিরে ধিরে উপলব্ধি করলাম আমার মূল্যমানও পরিত্যাক্ত আসবাবের মত হয়ে গেছে।
আজকাল ওদের আর আমার দিকে তাকানোর সময় নেই, ওদের দিকেই ভয়ে ভয়ে তাকাতে হয়। যাদের নিজে অ,আ শিখিয়েছি, তাদের দৃষ্টিতে আমি অবুঝ, অবিবেচক।
রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার পর, খাঁ খাঁ শূন্যতা এসে ভর করে। বিভ্রান্তির কালো ছায়া ধিরে ধিরে দীর্ঘতর হয়। আলোর দেয়ালগুলো মলিন হতে হতে কালো হয়ে যায়।
আমার ঘর, ইশ, বারবার ভুল হয়ে যায়!
আমার স্বামীর ঘরে থাকার অধিকারটুকুও দুর্বল হয়ে আসে। কারন সেটা এখন ছেলের সন্তানদের বড্ড প্রয়োজন।
পেনশানের সমস্থ টাকা দিয়ে ছোট ছেলেকে ইউ.এস.এ পাঠিয়েছি, সেই অপরাধে চরম অপরাধী আমি।
তাই বড় ছেলেটাও আমার খরচ বহন করতে অপারগতা দেখালো।
বাকি থাকলো মেয়ে- যে মায়ের ছেলের সংসারে জায়গা হয়না, সে কোন মুখে মেয়ে জামাইয়ের সাংসারে যেয়
বাকি থাকলো মেয়ে- যে মায়ের ছেলের সংসারে জায়গা হয়না, সে কোন মুখে মেয়ে জামাইয়ের সাংসারে যেয়ে দাঁড়াবে?
কার অভিযোগ কার কাছে করবো? সময়ের সাথে মনটাই ভঙ্গুর হয়ে গেছে। কষ্টগুলো আজ বরফের কফিনে জড়ানো, বড্ড শীতল। সম্বলহীন মানুষকে পরগাছার মত কাউকে জড়িয়েই বাঁচতে হয়। আর এই বাঁচাটা যে কতোটা অপমানের তা বোঝানো যায় না।
প্রাপ্তিহীন বোধ আর চারপাশের অবাঞ্চিত আচরন মিশে একটা বিষন্নতার ঢেউ তোলে স্নেহশীল তরলটাকে বড্ড শীতল করে তুলেছে।
না আর নয়, এবার পালাতে হবে এই চেনা জীবন থেকে। তাইতো পালিয়ে এলাম- একা, সম্পূর্ন একা আশ্রয়হীন আশ্রয়ে…
ছেলেবেলায় মা’কে বলতে শুনেছি– মেয়েদের জীবন নাকি কচুরির পানার জলের মতো?!
কোথাও স্থিতি নেই, ঢেউয়ের তোড়ে ভেসেই চলে। আর কতকাল ভাসবে এ জীবন? মৃত্যুর পরেও কি স্থিতি হবে না?
বাক্সে কালো কাপড়ে মোড়ানো যে পুটুলিটা, তাতে কিছু গয়না আছে। আজ আশ্রমের ম্যানেজারকে দিয়ে বলবো, আমার মৃত্যুর পর কবরের জমিটা যেনো কিনে নেয়।
মৃত্যুর পর অন্তত একটু স্থায়ী আশ্রয় চাই…
পড়তে পড়তে নাজমা বেগমের দু’গাল বেয়ে ঝড়া পানি মুছে মুছে শাড়ির আঁচল ভিজে যায়। তাহলে এই আশ্রমে সকলের জীবন কি একই কষ্টে মোড়ানো?
নিজের ছেলে, ছেলের বউ এদের মুখ ঘোলা আয়নায় ভেসে উঠে তলিয়ে যায়। কতদিন দেখে না নাড়ি ছেড়া সন্তানকে। চোখ মুছে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান তিনি। জানতে হবে সাজেদা বানুর কবরের মাটিটা কেনা হয়েছে কি না?!
ডিসেম্বরের বিকেল ফিসফিস করে বলে- কোথাও স্থিতি নেই, ঠিকানা নেই, ঢেউয়ের তোড়ে ভেসেই চলে- শ্যাওলা ধরা মানুষ জীবন...