ওপার বাংলার সমাজ বিশ্লেষক- অ ল ক জা না এর বিশ্লেষণ ধর্মী অসাধারণ লেখা “এক যাত্রী তক্তাপোশ”

673
ওপার বাংলার সমাজ বিশ্লেষক- অ ল ক জা না এর বিশ্লেষণ ধর্মী অসাধারণ লেখা “এক যাত্রী তক্তাপোশ”

এক যাত্রী তক্তাপোশ

——————-
অ ল ক জা না

ললাট লিখন অনুযায়ী কিছু গাছ শ্মশান যাত্রী। শবদাহে অংশগ্রহণ করে সহমরণ জীবনের অন্যতম ব্রত বলে মনে করে। কিছু গাছ গার্হস্থ্য জীবন ভালোবেসে আসবাবরূপে ফিরে আসে। নানান আকারের পরিচয় নিয়ে আমাদের আয়েস আরামের সহযোগী বন্ধু হয়ে ওঠে। এদের উপস্থিতি ও সহযোগিতা না থাকলে সুষ্ঠুভাবে সংসার করা সত্যিই কঠিন ছিল। এটা ঠিক যে তক্তাপোশ ছাড়া এমন অভ্যাস, দুচোখের পাতা এককরা যায়না, মানে ঘুমিই আসে না। কতকটা বিদ্যাসাগরের শয়ন বিলাসীর মতো।

মাটিতে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে হয়ত জীবনের বহু পরমায়ু খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন না ঘুমিয়েও নাজানা আতুর আবেগে রাত্রি কাবার হতেই পারে, ক্ষতিও নেই কিন্তু তক্তাপোশের সঙ্গ না পেলে মুহূর্তটা না জানি ব্যর্থ ব্যর্থ মনে হয়। পৈত্রিক ভিটেমাটি প্রাপ্তির সঙ্গে দু একটি মূকবধির সম্পত্তির মতো গাছও ভাগবাটোয়ারে পাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। নতুন নিজস্ব সংসারে সেটি হয়ত কখনো ককনো পিতামাতা বা সন্তানের আদলে অনেকখানি মায়া কেড়ে শাখাপ্রশাখা মিলিয়ে বাড়তে থাকে।

অর্থিক বিষয়ের জোয়ার বা প্রলোভন যাই আসুক না কেন, ঘাতক ব্যবসায়ীর হাত ওই আবেগ অবধি পৌঁছতে পারে না। বরং এক্ষেত্রে আসবাবপত্র বানিয়ে পরিবারের কিছু গৌণ সদস্যের মতোই সংসারে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার গল্প সমাজে আকছার দেখা যায়। তেমন একটি অতীত আমারও আছে। একটি তক্তাপোশ। একটি স্থায়ী রাতের ঠিকানা। আমার প্রথম যৌবনের বিপরীতার্থক শরীর কিংবা অস্তিত্ব। তখন হয়ত শৈশব। ঘুমের ভেতর দু-এক বার তা থেকে ভূমিতে পতন অস্বীকার করার উপায় নেই।

শোয়ার বিবিধ ভঙ্গিমায় হাঁটতে হাঁটতে এখন যৌবনের যাত্রী। তক্তাপোশটিও নানান অর্থের উপমায় এখন আমার সঙ্গেই সহবাসে অভ্যস্ত। সারাদিন যেখানে যেভাবেই কাটুক অনিবার্য রাত্রিবাস তার সঙ্গেই তার প্রশস্ত ধনুরাসন বুকেই। হয়ত কিছু অসমাপ্ত স্বপ্নের টুকরো থেকে গেছে, কিছু অশ্রু, ঘুমেরঘোরে বলে চলা অস্ফুট কথার সাক্ষীও। ঘাম, জ্বর কতকিছুই বয়ে বেড়াতে এখন অভ্যস্ত প্রিয় তক্তাপোশ।

কিছু টাকাকড়ি, কিছু পুরনো কাগজ একটি দুটি পোস্টকার্ড চিঠি সযত্নে চাদরের নিচে তার নির্জন বুকের কাছাকাছি ঢেকে রাখার দায়িত্ব কখনোই সে এড়িয়ে যায় না তো ? প্রতিদিনের প্রেম বিষণ্ণতা বিপর্যয় ও মিলনে তার উপস্থিতি এখন অস্বীকার করার উপায় নেই। নীরব সহযাত্রী। আমার, আমাদের একটি নির্ভরযোগ্য আধার কিংবা আশ্রয়। অভ্যাস মতো যার সঙ্গে পরমায়ুর
অর্জিত প্রহর কেটে যায়।

যাকে জড়িয়ে নাজানি হয়ত প্রথম যৌবনের স্বপ্নবিকার হয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিলনা। ভাগ্যে জড়িয়ে পড়া সহমর্মীর জায়গা সে নিতে পারেনা কখনো কিন্তু তার দাবিও তো কিছু নেই। প্রতিদিন তার বুকে বিবিধ শব্দ চষিয়ে নেমে আসে চির মুক্তির নিরাময় ভোর। অথচ ব্রাত্য কিন্তু না ভুলতে পারা প্রথম সম্পর্কের মতো কৃচ্ছ্রসাধনকেই এখন বড়োবেশি প্রশ্রয় ও সম্মান দিতে শিখে গেছে প্রিয় তক্তাপোশ। জৈবিক আগ্রহ ক্লান্ত হলে তিনি এখন অন্য ঘরে বাকি রাতটুকু নির্বিঘ্নে কাটাতে চলে যান। তখন আমি ও তক্তাপোশ একে অপরকে জড়িয়ে একাকার। হয়ত সহমরণ চেয়ে তার পক্ষে শ্মশান অবধি যাওয়া অসম্ভবও নয়।

Content Protection by DMCA.com

2 COMMENTS

  1. আমাদের জীবনের প্রতিটি পরতে জড়িয়ে থাকা তক্তাপোশের অঙ্গাঙ্গী দহন বিশ্লেষণ করেছেন কবি অলক জানা । অকপটে স্বীকার করেছেন শৈশব থেকে মৈথুন ,মৈথুন থেকে শেষ সহযাত্রীর অতপ্রত নাড়ী যোগ। লেখনীর সুদৃঢ় চেতনা আমাদের অত্যন্ত মুগ্ধ করেছেন কবি । সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here