শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,বেদনায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে সমাজ বিশ্লেষক-কলমযোদ্ধা হাসানুজ্জামান এর অসাধারণ লেখা “খোকাবাবু যেভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলো”

544
কলমযোদ্ধা হাসানুজ্জামান এর অসাধারণ লেখা “খোকাবাবু যেভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলো”

খোকাবাবু যেভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলো

                                               হাসানুজ্জামান

ভোরের সূর্য দেখেই বোঝা যায় সারাটা দিন কেমন যাবে। বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার চালচলন দেখেই অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলে বড় হলে একটা কিছু হবে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মনেওয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে ছোটবেলায় সবাই ‘খোকাবাবু ‘ বলে ডাকতো। পরবর্তীতে এই নামটি শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের লোকজন কদাচিৎ ব্যবহার করলেও বাইরের কোন লোকের মুখে আর শোনা যায়নি। অনেক আদর আর ভালোবাসায় গড়ে উঠেছিল খোকা বাবু’র শৈশবকাল। গ্রামের আর পাঁচটা ছেলের সাথে ডাঙ্গুলি খেলা, গাছের উপরে উঠে বসে থাকা, গুলটি দিয়ে ঘুঘু শিকার, এক গ্রামের ছেলেদের সাথে অন্যগ্রামের ছেলেদের বদন খেলা, তা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছেলেদের সাথে মারামারি করা , বাড়ীর পাশের বিলে ছোট ডিঙ্গিতে করে ঘোরাঘুরি করা, বিলে জাল দিয়ে মাছ ধরা,সকাল বেলা হলে বাড়ীর পূর্বাকাশে লাল সূর্যের আভা দেখে বেশ সময় কেটে যাচ্ছিল খোকাবাবুর।এভাবে খেলতে খেলতে কখন যে বয়স সাত বছরে পদার্পণ করেছে বুঝতেই পারেনি খোকা বাবুর পরিবার। একদিন বাবা সাথে করে নিয়ে গিয়ে বাড়ীর পাশের গিমারডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে আসে। সেই দিন থেকে খোকা বাবুর জীবনের নতুন পথচলা। পাড়ার বেশ কিছু ছেলে-মেয়েরা এই স্কুলে পড়ে। তারাও খোকা বাবুর আগে থেকেই পরিচিত। এদের মধ্যে অনেকেই তার খেলার সাথী। ফলে স্কুলে দূরন্ত এই কিশোরের খেলার সাথী সংগ্রহ করতে কালবিলম্ব হয়নি। বরং সাথে জুটেছে আরও অন্য এলাকার নতুন কিছু বন্ধু। তারা সকলেই খোকা বাবুর সাথে মিলেমিশে চলতো। তার চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। তারপর বাবা তার কর্মস্থল গোপালগঞ্জের মিশন সকুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। সেখানে খোকা বাবু সেই সময়ের গোপালগঞ্জ শহরের খ্যাতিমান শিক্ষক আব্দুল হামিদের সাহচর্যে আসেন। সেই শিক্ষকের ছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন‘ মুসলিম সেবা সমিতি’। এই সমিতির মাধ্যমে এলাকায় বাড়ী বাড়ী গিয়ে চাউল সংগ্রহ করা হতো। এই চাউল বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ গরীব ছাত্রদের পিছনে খরচ করা হতো। এক সময় প্রিয় এই শিক্ষকের মৃত্যুতে থমকে গেল সমিতির কাজ। খোকা বাবু সেই শিক্ষকের দায়িত্ব স্কন্ধে তুলে নিয়ে আগের কর্মকান্ড সচল রাখলো। ‘ মুসলিম সেবা সমিতির’ কর্মকান্ড এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। এই সমিতির মধ্যদিয়ে খোক াবাবুর প্রথম সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় মেলে। এরপর আর খোকা বাবুকে পিছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৩৮ সালে এলাকার হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জী সহপাঠি আব্দুল মালেককে মিথ্যা অভিযোগে মারধর করে। এ কথা শুনে খোকা বাবু আর স্থির থাকতে পারেনি। সহপাঠি বন্ধুদের সাথে নিয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। খোকা বাবুকে এক নম্বর আসামী করে মামলা হয়েছে। তরপরেও সহপাঠিকে মুক্ত করেই ছেড়েছে। খোকা বাবুর এই সাহস ও প্রতিবাদী মানসিকতার খবর দ্রুতই শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তার পরিচিতি শুধু আর স্কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাইরের চায়ের দোকানে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে,হাটে- বাজারে খোকা বাবুকে নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। একই সময়ে বাংলার গভর্ণর হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী এবং বাংলার অপর আরেক গভর্ণর আবুল কাশেম ফজলুল হক গেপালগঞ্জে আসেন জনসভা করতে। সেই জনসভার স্বেচ্ছাসেবকের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে খোকাবাবুর উপর। মিটিং শেষে খোকা বাবু হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দীকে মিশন স্কুলে নিয়ে যান। সেখানে মিশন স্কুলের হোস্টেল ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থা তাকে সরজমিনে দেখান। সোহরোওয়ার্দী সাহেব এই ঘটনায় খোকা বাবুর সাহস দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে কলকাতায় আমন্ত্রণ  জানান।

১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে খোকাবাবু নিজ এলাকা ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। তিনি পিছনে ফেলে আসেন অসংখ্য বন্ধু আর কৈশোর জীবনের বেদনাবিধূর সোনালী স্মৃতিগুলো। তার চোখে ভেসে উঠে টুঙ্গিপাড়া গ্রামের মেঠোপথ, বিলের মাঝের ডিঙ্গি নৌকা, আম-জাম, লিচু, বাঁশ বাগানের অপরুপ মায়াবী ছবিগুলো। সাঁরি সারি দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল-সুপারি গাছের লম্বা গাছগুলি। এ যেন একে অপরের আত্মীয়ের টানে ভালোবাসার গভীর বন্ধনে বাঁধা। মনে পড়ে রাস্তার মোড়ের হবু চাচার কথা। অতি ভোরে তিনি চায়ের দোকান খুলে বসে থাকতেন। চুলাতে লাড়কি দিয়ে বাতাস দিতে গিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলিতে বিরক্ত হলেও এ যেন চিরায়ত অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।এ যে হবু চাচার বহুকালের ব্যবসা। এরই মাঝে দু’একজন খরিদ্দারও দোকানের আশে পাশে এসে ঘোরাঘুরি শুরু করতো। এ সব স্মৃতিমাখা ছবি কিশোর খোকা বাবুর চোখে ভেসে উঠতেই মনের অজান্তেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখের কিনারা দিয়ে। দূরন্ত এই কিশোর ছন্দময় জীবনের চলন থেকে জীবন গড়তে আজ শহরের চারি দেওয়ালের মাঝে আটকে পড়েছে। ছুটে চলা জীবন থেকে ধরাবাঁধা এই জীবন কষ্ঠের বেড়াজালে আটকিয়ে দিয়েছে তাকে।

এক সময়ের বৃটিশদের রাজধানী ছিল এই কলকাতা শহর। ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসাবেও এক সময় এই শহরের কদর কম ছিল না। ইংরেজরা কলকাতা ছেড়ে দিল্লীকে রাজধানী বানালে এই শহরের গুরুত্বে ভাটা পড়ে। তারপরেও চারিদিকে লাল, নীল বাতি আর সাহেবী বাবুদের শহরে আনাগোনা বেশ চমকে দেয় মধ্যবিত্ত এই যুবক খোকাবাবুকে। অপরিচিত এই শহরে কেবল বড় বড় ভবনের দিকে তাকিয়ে বেশী দিন কাটাতে হয়নি খোকাবাবুকে। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তির পর খোকা বাবু উঠেছে কলেজের হোস্টেলে। ধরাবাঁধা জীবনের গন্ডি অতিক্রম করে একদিকে স্বপ্ন মেলে ধরার সময় অপরদিকে উপরে উঠার জন্য প্রয়োজন জীবনের বিশ্বস্থ সিঁড়ি। অদম্য সাহসী এই যুবক শুধু ঘরে বসে সময় কাটানোর ছেলে নয়। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই কলকাতায় নতুন করে পরিচয় হয় হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দীর সাথে। একদিকে চলে কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করার রাজনীতি অপরদিকে ঘন ঘন হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দীর সাথে দেখা করে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে তোলা। সবকিছুই জীবনের সাথে মিলিয়ে নেয় একটি মফঃস্বল শহর থেকে কলকাতায় আসা এই যুবক। কিছুদিনের মধ্যেই এই সাহসী যুবক ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনে সে মহাসচিবের পদটি সহজেই বাগিয়ে নেয়। এ সময় পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু- মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই দাঙ্গা ভাবিয়ে তুলে ভারতের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষদের। এই ভাবনায় আক্রান্ত হয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দীর মত বিশাল মনের রাজনীতিবিদ। তিনি প্রতিদিনই ছুটে চলেছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অজ্ঞলে। জনসভায় ভাষণ দিয়ে জনগনকে হত্যাযজ্ঞ থেকে সরে আসার আহবান জানাচ্ছেন। রানিংমেট হিসাবে সাথে নিয়েছেন গোপালগঞ্জের সেই সত্যবাদী , সাহসী যুবক শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময় ভারতবর্ষের জনগণের মাঝেও নেতা হিসাবে একটি জায়গা তৈরী করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ দ্বি-খন্ডিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্থানে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিভাগে ভর্তি হোন।এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের আন্দোলন চলছিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে । সাহসী এই তরুণ জানতে পারেন কর্মচারিদের দাবীগুলো ন্যায্য ও যৌক্তিক। যৌক্তিক দাবী বাস্তবায়নে তিনি ঘরে বসে না থেকে কর্মচারিদের পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে কর্তৃপক্ষ কোন বাচ বিচার না করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করেন। এ ঘটনায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি। তিনি পূর্ব পাকিস্থানের মুসলিমলীগে যোগদান করে পূর্ণদমে রাজনীতি শুরু করেন। এদেশ থেকে হিন্দুদের ভারতে চলে যাওয়া এবং ভারত থেকে মুসলিমদের স্রোতের মত চলে আসা তার মনকে
বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের মনে সমাজতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব দানা বেঁধে ওঠে। পূর্ব-পাকিস্থানের স্বায়ত্তশাসনের প্রথম সোপান হচ্ছে বাংলা ভাষা আন্দোলন। ভাষার দাবীতে পূবর্-পাকিস্থানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ দেশের বুদ্ধিজীবীরা পত্র-পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। তাদের লেখার মর্মবাণীগুলো শহর থেকে গ্রামে, হাটবাজারের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজসহ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মনে ভাষার দাবী ক্ষীণ থেকে প্রবল হতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলা নয় ‘ উর্দুকে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেয়’ । এই ঘোষণার খবরটি দ্রুতই পূর্ব-পাকিস্থানের আম জনতার মাঝে গিয়ে পৌঁছে। জনতা পাকিস্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ফজলুল হক হলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্থান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নীতিমালা ঘোষনা করেন এবং সেই নীতিমালা কন্ঠভোটে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। একই সাথে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষাসহ পূর্ব-পাকিস্থানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। এ সময় সচিবালয়ের সামনে থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নেতার মুক্তির দাবীতে ছাত্র সমাজের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার ১৫ ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক সংবর্ধনার আয়োজন করে। এই সংবর্ধনায় আন্দোলনমুখি ছাত্ররা শেখ মুজিবকে আপোষহীন নেতা হিসাবে তার ভ’য়শি প্রশংসা করে। এই সংবর্ধনা সভা ভন্ডুল করার চেষ্ঠা করে পাকিস্থানী সরকার । তারই প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৭ই মার্চ পুনরায় দেশব্যাপি ধর্মঘটের ডাক দেয়।

ক্রমাগত আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র সমাজের কাছে একজন জনপ্রিয় নেতায় যেমন পরিণত হোন তেমনি দেশবাসীর কাছেও তার পরিচয়ের ব্যাপ্তি ঘটে। ১৯৪৯ সালের ২ রা জুন হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলের নামকরণ করা হয় আওয়ামী মুসলিমলীগ। এই দলের পূর্ব- পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৫৩ সলের ৯ জুলাই পূর্ব-পাকিস্থান আওয়ামী মুসলিমলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মহাসচিব নির্বাচিত হয় শেখ মুজিবুর রহমান। একই সময়ে সকল দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে সরকারি দলের বিরুদ্ধে বিপুল বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসে। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টিতে জয়লাভ করে। এদের মধ্যে আবার আওয়ামী মুসলিমলীগ পায় ১৪৩টি আসন। অবিশ্বাস্য এই বিজয়ের পর সরকার গঠন করা হলে ৩৪ বছর বয়সি সর্বকনিষ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়া হয় কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আওয়ামীমুসলিমলীগের সম্মেলনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। দলের নতুন নামকরণ করা হয় আওয়ামীলীগ।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম-পাকিস্থানের লাহোরে উভয় পাকিস্থানের বিরোধী দল সমূহের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই অধিবেশনে পূর্ব-পাকিস্থান আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের সনদ হিসাবে পরিচিত ৬ দফা তুলে ধরেন। এই ছয় দফার পক্ষে অধিবেশনে বিরোধীদল সমূহের মতামত চাওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ দলই সেদিন ছয় দফার পক্ষে মত দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তারা এই ছয় দফার মধ্যে পূর্ব-পাকিস্থানকে বিচ্ছিন্ন করার আলামত দেখতে পান। তাদের এই বক্তব্য সেদিন সরকারের বক্তব্যের সাথে এক হয়ে যায়।ফলে শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘটনার প্রতিবাদ করে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ আওয়ামীলীগের কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হোন। তারপর ৬ দফার পক্ষে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে সারা দেশে সফর শুরু করেন। । সিলেট ও ময়মনসিংহ অজ্ঞলে সফরের সময় পাকিস্তানী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। নেতার মুক্তির দাবীতে ৭ জুন সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘটে সারা দেশের ছাত্র-জনতা সর্বাত্বক অংশ গ্রহণ করে। এই সময় শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের মুখে মুখে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। শেখ মুজিবুর রহমানের গতিকে থামিয়ে দিতে পাকিস্তানী সরকার উঠেপড়ে লাগে। তাদের রাতের ঘুম যেন হারাম হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কাছে একটি আতংকের নাম। কোনভাবেই তাকে আটকাতে না পেরে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এই মিথ্যা মামলাটি করা হয় ১৯৬৮ সালে। আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলার আকাশে উত্তাল হাওয়া বইতে শুরু করে। আমজনতার মাঝে একদিকে মুক্তির তীব্র আকাক্ষা অপরদিকে পশ্চিমাশাসকগোষ্ঠীর ভয়ংকর থাবা থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায় তা নিয়ে ভাবনা। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সরকারের কাছে ছয় দফার সমন্বয়ে ১১ দফা দাবী উৎথ্বাপন করেন। এই দাবীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন তথা পরোক্ষ স্বাধীনতার কথা বলা ছিল। সেই সময় দ্রুত প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দেশের স্বাধীনতার লক্ষে ছাত্র-জনতা এক হয়ে যায়। দূর্বার গণআন্দোলনের লক্ষে মানুষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ‘ জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে বাংলার আকাশ বাতাস। পরিস্তিতি জনগণকে জানানোর উদ্দেশ্যে আওয়ামীলীগ পল্টনে জনসভা আহবান করে। এই জনসভায় অংশ নিতে সারা বাংলা থেকে ট্রেনে-বাসে করে হাজার হাজার মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা আসতে থাকে। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত মানুষের এই ঢল দেখে শাসকগোষ্ঠেী বিচলিত হয়ে ওঠে। আতংগ্রস্থ শাসকগোষ্ঠেী গণতন্ত্রের সকল নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে ঢাকামুখি ছাত্র-জনতার উপর সেদিন হিংস্রদানবের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদিকে সিভিল ড্রেসপরা সরকারের পেটুয়া বাহিনী অপরদিকে পুলিশ বাহিনীর যৌথ আক্রমণে মফঃস্বল থেকে ঢাকার পল্টনের জনসভায় আসতে থাকা ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আহত হয় বেশ কিছু কর্মী। অনেকেই পুলিশের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে শহরের অলিতে গলিতে। এর মধ্যে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনেকেই সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হতে সক্ষম হয়। শুরু হয় সমাবেশ। সমাবেশ চলাকালিন ছাত্র-জনতার মাঝখান থেকে মূর্হু মূর্হু শ্লোগান উঠতে থাকে- ‘ তোমার আমার ঠিকানা , পদ্মা মেঘনা যমুনা ।জয় বাংলা।’ শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পল্টন ময়দান। ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতাকে সামনে রেখে আপোষহীন , সাহসী নেতৃত্বের কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন ‘ বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ’ষিত করে। । শেখ মুজিবুর রহমানকে এই বিশেষণে বিশেষিত করার পর লক্ষ লক্ষ ছাত্র- জনতা সমর্থন জানিয়ে হাততুলে সমস্বরে শ্লোগান দিতে থাকে-‘ জয় বাংলা’ জয় বঙ্গবন্ধু’।

যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক টনিবেন ( লর্ড ওয়েজউড) তার বইতে লিখেছেন-‘ নেহেরেু-জিন্নাহ দ‘ুজনেই পশ্চিমা দেশে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ সেক্যুলার রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে ভারতবর্ষকে হিন্দু ও মুসলিমে বিভক্ত করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান বিদেশে শিক্ষা না নিয়েও নিজ দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মন্ত্রমুগ্ধে সকল ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।’

খোকা বাবু স্কুল জীবন থেকে শুরু করে আমৃত্য রাজনীতি করেছেন। তার রাজনৈতিক জীবনের বড় বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে তিনি কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। প্রতিবাদী ও সাহসী মনোভাব তাকে এদেশের লক্ষ ছাত্র-জনতার হূদয় বেদিতে দেদিপ্যমান করে রেখেছে। জনগণের মাঝ থেকে বেড়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মধ্যে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন তেমনি বিদেশের মাটিতেও তার সমধিক পরিচিতি গড়ে ওঠে। গণতন্ত্রকামী নেতাদের কাছে তিনি ছিলেন একজন সন্মানীয় ব্যক্তি। মানুষের সাথে মেলামেশার এক অপূর্ব সন্মোহনী শক্তি ছিল তার। ফলে সহজেই মানুষের মনের মধ্যে প্রবেশ করে মানুষকে তার পক্ষে টানতে পারতেন। এমন বহুবিধ গুনাবলির অধিকারি নেতা পৃথিবীতে কমই এসেছে।

লেখক :  গবেষক। ০১৭১১-১০৮৭৩৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here