কলমযোদ্ধা-হাসানুজ্জামান এর কমরেড জসিম মন্ডল তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “কমরেড জসিম মন্ডল : অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক ”

407
গত ২রা অক্টোবর’২০ কমরেড জসিম মন্ডলের তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী ছিল ।

কমরেড জসিম মন্ডল : অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক

হাসানুজ্জামান

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল একজন ত্যাগী,সৎ, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন কমিউনিষ্ট নেতা ছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে আজীবন আন্দোলন করেছেন শাসকদের বিরুদ্ধে। আন্দোলন করতে গিয়ে শাসকদলের রোষানলে পড়ে জীবনের তারুণ্যের একটি বড় অংশ প্রায় আঠার বছর জেল খেঠেছেন। পাকিস্তান সরকার কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধের পর বছরের পর বছর তিনি মানুষের বাড়ী বাড়ী কখনো কখনো জঙ্গলে পালিয়ে বেড়িয়েছেন । মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে সঁপে দেয়া এই নেতা ২০১৭ সালের ২ রা অক্টোবর ভোরে ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশসহ ভারতের প্রগতিশীল মনা রাজনৈতিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার কালিদাসপুর গ্রামে জন্ম নেয়া জসিমমন্ডল কিশোর বয়সে বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। রেলওয়েতে ছোট চাকুরি করতেন বাবা হাউস উদ্দিন। থাকতেন কোলকাতা শহরের রেলওয়ে কলোনীতে। বাবা মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন শহরের মুরালি মোড়ের কমিউনিষ্ট পার্টির অফিসে যাতায়াত করতেন। সেখান থেকে পরিচয় হয় ভারতের বাম ঘরোনার প্রসিদ্ধনেতা জ্যোতিবসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ,রণেশ মিত্র সহ অসংখ্য নেতার। তাদের চিন্তা-চেতনার একটি বড় অংশ জসিম মন্ডলকে প্রগতিশীল রাজনীতিতে নিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই সময় কলকাতায় প্রতিনিয়ত বৃটিশবিরোধী মিছিল বের হতো। সেই মিছিলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন জসিম মন্ডল। বাবা- মা ছেলের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ার খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে নিতে জসিম মন্ডলকে রেলওয়েতে ট্রেন চালকের হেলপারের চাকুরিতে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু জসিম মন্ডল বাবা মায়ের সেই পথে না গিয়ে চাকুরিরত অবস্থায় রেলওয়ের শ্রমিকদের বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে থাকে । খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জসিম মন্ডল শ্রমিকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। শ্রমিকনেতা হিসাবে চারিদিকে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।
প্রায় দুই শত বছর ভারত বর্ষ শাসনের মধ্যদিয়ে জনগণের রোষানলে পড়ে ইংরেজ সরকার। ইংরেজ হটাও আন্দোলনে ভারতবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলনের মুখে তারা এদেশ থেকে চলে চাওয়ার মূহূর্তে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিমদের মাঝে সংঘর্ষের অবতারণা করে। রক্তের হোলিখেলায় বিক্ষুব্ধ জসিম মন্ডল হিন্দু-মুসলিম শ্রমিকদের হত্যাযজ্ঞ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্ঠা করেন। ১৯৪৬ সালে কোলকাতার শিয়ালদহ থেকে আসামমুখি ছেড়ে আসা মেইল ট্রেন রানাঘাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়। এ সময় তিনি চালককে দিয়ে ট্রেনটি স্টেশনে না থামিয়ে দ্রুত সামনের দিকে নিয়ে চলে যান। এ ঘটনায় সেদিন ট্রেন লাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু দাঙ্গাকারি মারা গেলেও ট্রেনের পাঁচ হাজার যাত্রী প্রাণে রক্ষা পায়। জসিম মন্ডলের সেদিনকার বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের রক্ষা করার খবরটি মিডিয়ায় দেশ ও দেশের বাইরে চাউর হয়ে যায়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অভিনন্দন জানায় জসিম মন্ডলসহ ট্রেন চালককে।
দেশ বিভাগের পর জসিম মন্ডল পূর্বপাকিস্থানের রেলওয়ে শহর ঈশ্বরদীতে এসে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করেন।এ সময় সারা দেশে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে অধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেই সময় রেলওয়ে শ্রমিকদের রেশনের যে চাউল দেয়া হতো তা খুবই নিন্মমানের। অনেকটা দেখতে চাউলের খুদের মত। এই চাউল নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ কাজ করছিল। এই সময়ে রেলওয়ে শহর সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানা পরিদর্শনে আসেন তৎকালিন মুসলিমলীগ সরকারের মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার। কমরেড জসিম মন্ডলের নেতৃত্বে একদল শ্রমিক রেশনে খুদের পরিবর্তে চাল দেওয়ার দাবী নিয়ে মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করতে চাইলে মন্ত্রী সাক্ষাত দিতে অশ্বীকার করেন। ফলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মন্ত্রীকে বহনকারি ট্রেনের সংযোগ লাইন কেটে দেয়।পরে মন্ত্রী শ্রমিকদের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়।
বাংলা ভাষার আন্দোলনে ছাত্র-জনতা যখন রাস্তার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই সময়ে জেলের প্রকোষ্ঠে সময় কাটাচ্ছে এই শ্রমিকনেতা কমরেড জসিম মন্ডলসহ রণেশদাসগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহিদুল্লাহ কায়সার। দেশের পরিবর্তনের জন্য তারা জেল খানাতে বসে থাকেননি। শুধুই রাজনীতি দিয়ে দেশের কোন পরিবর্তন হবে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার। এই লক্ষ্য নিয়ে সেদিন জেলখানাতে বসে আজকের একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই কমরেড জসিম মন্ডলসহ বেশ কিছু আওয়ামীলীগ নেতার নেতৃতে স্থানীয় জনগণ ঈশ্বরদী বিমানবন্দর আক্রমণ করে বিমানবন্দরে কর্মরত ১১ জন পাকিস্তানী অফিসারকে হত্যা করে। তারপরেই জসিম মন্ডল তার পরিবার নিয়ে কোলকাতায় চলে যান। সেখানে পুরো নয় মাস তিনি কমরেড ইন্দ্রজিত গুপ্ত, রণেশ মিত্র, ইলামিত্রকে সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরেছেন। তাদের সমস্যা শুনে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর জিয়া এবং এরশাদ সরকারের রোষানলে পড়ে বার বার জেল খেটেছেন। জেল থেকে বের হয়ে পুনরায় সরকার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাঠে নেমেছেন।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে দেশ প্রেমিক এই নেতা সারা বাংলায় জনসভা করার মধ্যদিয়ে শ্রমিক-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তার সুললিত ও রসাত্বক বক্তব্য সহজেই মানুষকে আকৃষ্ঠ করতো। জসিম মন্ডলের জনসভার কথা শুনলেই দূর-দূরান্ত থেকে পা ফাঁঠা মানুষরা সমাবেশ স্থলে এসে উপস্থিত হয়ে নেতার সাহসী ও স্পষ্ঠ বক্তব্য শুনে বিমোহিত হতো। একদিকে ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্রতার সাথে লড়াই অপরদিকে শোষকের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই জসিমমন্ডলকে করেছে মহিয়ান। নিজ দল ও আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে ছয় দশকের বেশী শ্রেণী সংগ্রামের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন ইতিহাস। স্বৈরাচার সরকারের অনেক বড় বড় প্রলোভন আদর্শ থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। নীতি,নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কারণেই স্বৈরাচার সরকারের মদদপুষ্ঠ সেই সময়ের কুষ্ঠিয়া জেলা পরিষদের দূর্নীতিগ্রস্থ চেয়ারম্যান আপন জামাই এবং বিমানে কর্মরত ছেলেকে গ্রেফতারের জন্য প্রকাশ্য জনসভায় বক্তব্য দিয়ে দেশব্যাপি আলোচিত হয়েছেন এবং সমালোচিত হয়েছেন নিজ পরিবারের মধ্যে।
পাবনার ঈশ্বরদীর নিজ বাড়ীর সামনে নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পশ্চিমটেংরী প্রাথমিক বিদ্যালয় হলেও জনগণ এই স্কুলকে জসিম মন্ডলের স্কুল হিসাবেই জানে। তার ইচ্ছা ছিল এই স্কুলে শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিঞ্জানমনস্ক করে গড়ে তুলবেন। এলাকার শিশুদের আলোকিত মানুষরুপে গড়ে তোলতে তার প্রেরণা ও উদ্যোগে জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন এর একটি শাখা খোলা হয়। শিশু সংগঠনটির নামকরণ করা হয় ‘ সমষ্ঠি খেলাঘর আসর’। তার নিজ বাড়ীর একটি কক্ষে স্থাপন করা হয় উদীচীর শাখা।
আজকের প্রেক্ষাপটে তার মত ত্যাগী , আদর্শবাদী ও প্রগতিশীলমনা রাজনৈতিক খুবই বিরল। তাকে অনুসরণ করলে সমাজ, দেশ ,জাতি তার কাঙ্কিত লক্ষৌ পৌঁছতে সহজ হবে। নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে বিজ্ঞান মনস্ক চেতনার মধ্যদিয়ে। দেশে বিদ্যমান সন্ত্রাস, দূর্নীতি , জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদী রাজনীতি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে সোনার বাংলা হবে। সকল জাতি,ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে স্বাচ্ছন্দে আমাদের প্রিয় এই দেশে বসবাসের মধ্যদিয়ে কাঙ্খিত উন্নয়নের অংশীদার হতে পারবে। ফলে যুগ যুগ ধরে এই নেতা তৃতীয় বিশ্বের অধিকার বজ্ঞিত মানুষের হূদয়ে ঠাঁই করে বেঁচে থাকবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক। ০১৭১১-১০৮৭৩৬

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here