রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ
হাসানুজ্জামান
বাংলা সাহিত্য রচনায় কোন নিয়মনীতি না থাকায় সুললিত সাহিত্য নির্মাণ হচ্ছিল না। কেবলমাত্র ধর্মীয় কিছু পুরাণকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল সাহিত্যমোদী মানুষ। কিন্তু তা ছিল নিছকই মনের সাময়িক আনন্দের উন্মাদনা। এই বিচ্ছিন্ন সাহিত্য র্চ্চার গতিকে একটি ধারাতে রুপায়িত করলেন ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর। বাংলা সাহিত্যে সুখপাঠ্য ব্যাকরণ নির্মাণের মধ্যদিয়ে সাহিত্যের একটি নতুন গতিধারার সৃষ্ঠি করেন তিনি। সাহিত্যের সেই চেনাজানা পথ ধরেই এগিয়ে গেলেন মাইকেল মধুসূদনদত্ত, বঙ্কিমচন্দ্রচট্রোপাধ্যায় । তাঁেদর হাতেই বাংলা সাহিত্য প্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া পেল। সমৃদ্ধি পেল সাহিত্যের বিচিত্র অঙ্গন। রিলেরেসের সেই পথ ধরেই এগিয়ে আসলেন বিশ্বনন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম। তারপরেই কবিতা সাহিত্যকে চিত্রময় করে তোলতে অসামান্য অবদান রেখেছেন রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর হাতের স্পর্শে শিল্পমূল্য বিচারে কবিতায় ওঠে আসে প্রাণের স্পন্দন। সেই স্পন্দনকে এখনও কোন কবি অতিক্রম করতে পারেনি।
‘ হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক , চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন
আমারে দ‘ুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’
১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক কবি হিসাবে খ্যাত জীবনানন্দ দাশ। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর এক ট্রাম দূর্ঘটনায় কলিকাতায় মারা যায় এই নিসর্গ প্রেমিক কবি। মেধাবী ছাত্র জীবনানন্দ দাশ স্কুল ও কলেজ জীবনের পাঠ চুকিয়ে বরিশাল থেকে চলে আসেন কলিকাতায়। কলিকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে এমএ উত্তীর্ণ হয়ে ভাগ্যাষ্ণণে ছুটে বেরিয়েছেন পুরোভারতবর্ষে। কখনো ঢাকা, কখনো কলিকাতা কখনো দিল্লী ছুটে গেছেন চাকুরির জন্য। চাকুরি হলেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তিনি। সবশেষে তার চাকুরি হয় কলিকাতা সিটি কলেজে। প্রিয় এই শহরটির মায়ামমতায় আষ্ট্রেপৃষ্ঠে নিজেকে সঁপেদিয়ে রেখেছেন কবি। শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে তার পদচারণা তাকে করেছে মহিয়ান। ভালোবাসা ও বেদনার রঙে নিজের মনের আঙিনায় আঁকিয়ে রেখেছেন শহরের চিত্রবৈভব। ফলে জীবনের সবলেনদেন শেষে আবার ফিরে আসা এই শহরের সিটি কলেজে শিক্ষক হিসাবে তার চাকুরি জীবনের প্রকৃত অভিষেক ঘটে। সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তার চাকুরিস্থল সিটি কলেজে ছাত্র সংকট দেখা দেয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ এই ওজুহাতে বেশ কিছু শিক্ষকের চাকুরিচ্যুতি ঘটায়। এই চাক্যুরিচ্যুতির তালিকায় জীবনানন্দ দাশের নামটিও উঠে আসে। কলিকাতার সিটি কলেজ থেকে তার চাকুরিচ্যুতি তাকে নিয়ে যায় হতাশার রাজ্যে। জীবনের নানা চরাই উৎরাই পেরিয়ে এক সময় জীবন নৌকার হাল শক্তভাবেই ধরেছিলেন এই কবি। কিন্তু সেখান থেকে তার পদচ্যুতি তাকে করেছে নৈরাশ্যবাদী। ব্যক্তিজীবনের এই হতাশা, নৈরাশ্য তার কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে। দুঃখবাদী এই কবির কবিতায় জীবনের কষ্ঠের চিত্রগুলো এক সময় নান্দনিকতায় রুপ পেয়েছে। সুখপাঠ্য হয়েছে কবির কবিতা। যুগ উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজি, ফরাসী ভাষায় অনুদিত হয়ে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মানুষের কাছে ও ছড়িয়ে গেছে কবিতার মূল বাণী।
সাহিত্যে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে সুন্দরের রাণী হিসাবে। সেই রাণীর মুখাবয়ব , চুল , শরীরের নিখুত ,রোমান্টিক বর্ণনার মধ্যদিয়ে নারীকে করা হয়েছে সন্মানিত। পদ্য সাহিত্যে নারীর এমন বর্ননা আর কোন সাহিত্যিক ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে কিনা জানা নেই। তবে হতাশা ও নৈরাশ্যবাদী এই কবির কবিতায় নারী হয়ে উঠেছে দেদীপ্যমান একজন আদর্শবাদী দেবী। যার সৌন্দর্য শুধুু নারীকে নয় পুরো জগতকে করেছে মহিমান্বিত। পাশাপাশি কবি হয়ে উঠেছেন মহান। ধন্য হয়েছে সাহিত্যের বিভিন্ন প্রান্তর। কবি নৈরাশ্যের মধ্যেও খুজে পেয়েছেন নারীর অপূলক সৌন্দর্য। —
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে এতদিন কোথায় ছিলেন ?
পাখীর নীড়ের মতো ‘ চোখ তুলে’ নাটোরের বনলতা সেন’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতবর্ষের এক সাহিত্যিক পরিবারে। ধর্মীয় গোড়ামী তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। একদিকে বাবার ব্রক্ষ্যধর্ম র্চ্চা কবিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে অপরদিকে পারিবারিক সাহিত্য চর্চা কবিকে আধুনিক মানুষ তৈরীতে সাহায্য করেছে। তার পূর্বপুরুষরা বড় কোন সাহিত্যিক হতে পারেনি সত্যি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত সাহিত্যিক তৈরীর জন্য তারা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র তৈরী করেছেন। ঠিক এমনিভাবে কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন সাহিত্যকর্মী। তার লেখা সেই জনপ্রিয় কবিতা
“ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”।
কবির মাতার এই কবিতাটি শিশুদের জন্য জনপ্রিয় একটি কবিতা। যে কবিতাটি আমরা কমবেশী সকলেই আনন্দের সাথে পড়েছি এবং সকলের মুখে মুখে কবিতাটি উচ্চারিত হতে দেখি। ফলে কবি বা সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পিছনে পরিবারের একটি ভুমিকা কে কখনো ছোট করে দেখা যায় না।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও গবেষক। ০১৭১১-১০৮৭৩৬