সমাজ-সভ্যতার সাম্য দর্শনের কলামিষ্ট হাসান আহমেদ চিশতীর বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “মা-এর স্মৃতি,চলমান সভ্যতাএবংআমি ও আমরা”

398
কলামিষ্ট হাসান আহমেদ চিশতীর বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “মা-এর স্মৃতি, চলমান সভ্যতা এবং আমি ও আমরা”

মা-এর স্মৃতি, চলমান সভ্যতা এবং আমি ও আমরা
—–হাসান আহমেদ চিশতী—–

আজকের বিশ্ব বিজ্ঞানের কৃপায় এক চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। সব কিচুতেই পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন এর প্রলেপ দিযে অতি প্রাকৃত মৌলিকত্বকে ঢেকে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবু মা, মাটি ও মানুষ, পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত: পর্যন্ত একই রয়ে যাবে। একজন মানুষ হিসাবে এই মাটির পৃথিবীতে মায়ের গর্ভজাত সন্তান আমি। জন্মেই যার মুখ আমি দেখেছি সে আমার মা’-। যার প্রথম স্পর্শে আমার ইন্দ্রিয় জেগেছে, যার ছায়ায় আমার চেতনা চিত্রিত হয়েছে, সে আমার মা’-।

মা-এর অস্তিত্ব নিয়েই আমার পৃথিবীর প্রথম ও প্রধান জ্ঞান বিকশিত হয়েছে। মস্তিষ্কের বাতিঘরে প্রথম প্রদীপ জ্বালায় যে, সে আমার মা’-। মা-এর স্নেহ মায়া-মমতায় বেড়ে ওঠা জীবনের প্রতিটি স্তরে বিন্যাস্ত থাকে তারই অনুরণন, অনুকরণের ছায়া। সুতরাং ছেলেবেলায় যে মনোজগৎ তৈরি হয় মাতৃমঙ্গলের ধারায়। তারই প্রতিফলন ঘটে বাকী জীবনের সর্বময়তায়। আমি বই পড়তে শিখেছি আমার মা’-এর কাছ থেকে। একজন পাঠক হিসাবে, একজন লেখক হিসাবে যতটুকুই লিখি বা পড়ি না কেনও, তাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি এবং নিয়মিত লেখা-পড়া আমার খাদ্যাভ্যাসের মত হয়ে গেছে। এতো আমার মা’ এর কৃপায়। কারণ মা’কে দেখেছি তার বিছানায় বালিশের নিচে বই থাকা চাই। পারিবারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে যখনি একটু বিশ্রাম করবে মা, তখনি বইটা চোখের সামনে ধরে দু’চার পাতা পড়তে পড়তে অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়তো। যখন বুঝতে শিখেছি তখন আমার সাথে শেয়ার করে চলেছে তাঁর বই পড়া। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও বাস্তবতায় মায়ের মত অসম্ভব ভাল বন্ধু, অবারিত নিরঙ্কুশ ভালবাসায় যতটা সাহস ও শক্তি পেয়েছি, পৃথিবীর আর কোন কিছুতেই এতো শক্তি ধারণ করে না। কি অসাধারণ ছিল তার শুদ্ধ স্বরে বাক্য বিন্যাস করে কথা বলা এবং বিখ্যাত সব উদ্ধৃতি দিয়ে সে আমাকে শোনাত জীবন কথা। মা হারানোর কথা আমি বলবো না- সে আমার সহ্য হয় না। আমার শ্রদ্ধার্ঘের সবটুকু তাঁর পদতলে সমর্পন করে নিঃশেষ হতে চাই পুন:পুন:। এই হলো আমার মা’-স্বর্গের চেয়ে দামী।
যে আজও আমাকে তাড়িত করে একটি ভাল বই এর মনোযোগী পাঠক হতে। পরিবারে অন্যদের যত ভূমিকাই থাক, আজ শুধু মা’ এর কথাই হোক। ভারতচন্দ্রের সেই কাব্য কথাটি- “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে”। এই যে হৃদয় নিংড়ানো মা-এর অবারিত আশির্বাদ। এর প্রতিফলন বা বিকাশ হবে কিভাবে। সে প্রসঙ্গে দার্শনিক বলছেন, তুমি আমাকে একজন ভাল বা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি ভাল জাতি উপহার দেব। অর্থাৎ মা’ই হলো একমাত্র সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান প্রতিষ্ঠান। তাই হয়তো সেই গুরুগৃহের মত বলা হয়- মাতুলালয়, মাতৃগৃহ, মাতৃসদন, মাতৃমন্দিরসহ কত কি। এমন কি দেবীকে পর্যন্ত আহ্বান করা হয় “মাতৃরূপেন সংস্থিতা”। মুসলিম ধর্মে তো বলা হয় মায়ের পদতলে সন্তানের স্বর্গ। অথচ প্রকৃত সভ্যতা থমকে দাঁড়ায়। এতো কিছুর পরও যখন সন্তান বিপথে যায়, তখন সত্যি করেই সভ্যতার মেটাতে হয় দায়। কারণ গতি-প্রগতির ধারা, বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা শুধু চাক্চিক্যই এনে দেয়নি, সেই সাথে এনে দিয়েছে জীবনের নবতর বিন্যাস। মা’ এর ভূমিকা এবং পরিবার পালনের প্রচলিত ধারণা আজ বদল হয়ে চলেছে। শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য মাতৃদুগ্ধ পান, সীমান্তের মত কাঁটা তারের ব্যবধান। তার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে আধুনিক ডাক্তার আর বেবী ফুড। শিক্ষার জন্য ধরাবাঁধা নিয়মের শিশুতোষ আর কিন্ডারগার্টেন জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম নিয়ন্ত্রণে লালিত এসব শিশুই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। যাদের মা এর দুধের জোর থেকে বেবী ফুডের জোর বেশী এবং বাউল গানের সেই লিরিক- কাটিয়া গায়ের চাম, একধার দুধের দাম শোধ করাও লাগবে না। সুতরাং এমন প্রজন্মের পরাক্রম চেতনার প্রবণতা মানসিক ও মাণবিকতায় বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে এবং অসহযোগী মনোভাব দেখা দেয়। কেননা তারা মাতৃবন্ধনের প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে বেড়ে উঠছে না। অপরপক্ষে মাতা ও মর্জ্জি মাফিক ব্যাস্ততায় আকাশ সংস্কৃতি কিংবা জীবন/জীবিকার কর্মতৎপরতাু আবদ্ধ হয়ে পড়ঝেন, একজন কর্মজীবি!নারী হিসাবে।
ফলশ্র“তিতে দেখা যাচ্ছে মাতার সাথে সন্তানের সংস্পর্শের সম্পর্ক নয়, স্নেহের সম্পর্ক নয়, উষ্ণতার সম্পর্ক নয় যে সেটা হচ্ছে একেবার ভার্চুয়াল সম্পর্ক। যেটা জীবন –বাধের ধারণাকে পাল্টে ফেলছে এবং অন্য কিছুতে প্রবাহিত করে নানামুখি আসক্তির মায়ায় ছুটছে। প্রকৃত মায়া-মমতার মানষিকতা বুলে পড়ছে মাত্রিছায়া আর ভিন্ন প্রভাবের প্রবাহিত ধারার মাঝখানে। সম্পর্কের এই টানাপোড়নের কারণে সামাজিক অবক্ষয়,০শোষণ, বঞ্চনা,ও হিংসা নিষ্ঠুরতার ধারাক্রম বেড়েঞ্চ চলেছে। মেয়েদের প্রতি সুন্দর ও স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি কলুষমুক্ত হচ্ছে না। ফলে ইভটিজিং, নারী অপহরণ, ধর্ষণসহ নানবিধ অন্যায় অত্যাচারের অস্থিরতা লেগেই থাকছে।
অথচ মাতৃভাষার জন্য যুদ্ধ করে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য উদাহরণ। বিশ্ব সাহিত্যে, চিত্রকলায়, ইতিহাসে, দর্শণে, এমনকি ধর্মশাস্ত্র বা তত্ত্বে মা এর গুরুত্ব অপরিসীম। আদিম ইতিহাসে মা’এর গোত্র শাসন, মাতৃপূজা প্রচলিত ছিল। বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা মা’এর পোর্ট্রটে, মা এর ভাষ্কয্য। বিখ্যাত উপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কির মা’ উপন্যাসসহ হাজারো উপাখ্যান মা’ এর জন্য উৎসর্গ। সম্প্রতি এই উপমহাদেশের বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী মান্নাদের একটি গানের সিডি মা’ বের হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় খুদিরামের সেই গান- একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি…. একসময় মানুষের মুখে মুখে ছিল। আঁতুর ঘর থেকে শুরু করে মায়ের কাঁথা, মায়ের কাজল, টিপ যাতে সন্তানের প্রতি কারো নজর না লাগে এর জন্য কতরকমের প্রস্তুতি ছিল। এছাড়াও শিল্পকলায় মা’এর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অবারিত অনন্তকাল। জারি, সারি, পল্লীগীতি লোকায়ত লোকগাঁথা লোকজ গানে মা-এর কথা বহু-বচনে, প্রবচন আছে। বাউল গানে আমরা শুনে থাকি গায়ের চামড়া কেটে জুতা বানায় দিলেও মায়ের একধার দুধের দাম শোধ হবে না। আধ্যাত্মিক মনিষিদের জীবনীতে দেখেছি- মা’এর তুষ্টি লাভের আশায় বৃদ্ধা মাতাকে সমস্ত সময় পিঠে বহণ করে চলেছেন। আবার মায়ের আদেশ শিরধার্য্য করে সমস্ত রাত পানির গ্লাসহাতে করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, ঘুমন্ত মা এর পাশে। অর্থাৎ মা এর গুরুত্ব নির্ণীত হয়েছে যেন বিধির অপার লিলায়। বিভিন্ন মিথ বা মাইথলজির আঙ্গিকে মা এর অভিশাপে নরকবাস কিংবা অভিশপ্ত জীবনের খেসারত টানছে, এমন উপাখ্যান চরমভাবেই চিত্রিত হয়েছে। আমাদের অঞ্চলের একজন মাদ্রাজী ঝাড়ুদারকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম- “কি ডেমরু, শুনলাম তুমি না-কি টাকা নিয়ে খৃষ্টান হয়ে গেলে? ডেমরু উত্তরে বললো- ছিঃ ছিঃ বাবু, ছোট জাত হতে পারি কিন্তু ছোটবেলায় মা’ মন্দির দেখা-লো, এখনো ওখানেই যাচ্ছি। এই যে, মা’ এর প্রতিশ্রদ্ধা, কি সাংঘাতিক। চলন্ত গাড়ীতে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আমরা দেখি লিখা থাকে ‘মা এর দোয়া’- অর্থাৎ মাতৃভক্তির প্রতি প্রচন্ড আস্থা, যেখানে কাজের শক্তি যোগায় এবং উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী, এ যেন তারই প্রমাণ।
সংস্কৃত দর্শনে পড়েছি- “বিনয়ং ভষিভূতং ভবেৎ” বিনয় জগতকে ভষ্মিভূত করে। এই বিনয়ের যখন অভাব হয়, মুখ গোমরা বা বিষন্নভাবে কেউ কালো করে তোলে তখন সাধারণ একটি উক্তি প্রচলিত ধারায় শোনা যায় যে, জন্মের পরে কি মা মুখে মধু দেয়নি। অর্থাৎ মধুর নিরাময়যোগ্য পুষ্টিগুণ বঞ্চিত সন্তান। আবার কেউ যদি কোন শক্তি প্রদর্শনের হূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন বলে যে, ‘কার মা’ এর দুধের জোর কত এবার প্রমাণ হবে। অর্থাৎ মা-এর দুধেু পুষ্টি!গুণের চিরায়ত প্রকাশ। পূশাপাশি সন্তাপের$উৎকর্ষতায় স্বর্ণগর্ভা মা এর কথা যেমন আমরা জানি তেমন বিরঙ্গনা মায়ের কথাও আমাদের স্বাধীব্জতা যুদ্ধের সাথে সর্বজন শ্রদ্ধা স্মরণ হয়ে থাকে। সুতরাং মা এর উচ্চাসন সর্বকস্খলের সর্বধারায় জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশে— স্ববিনীত শ্রদ্ধায় মহামঙ্গলের আদর্শ সিঁড়ি। মা-এর ভূষণ, মা-এর বাসন, মা এর কসম, মায়ের আসন, মায়ের বাসন, মায়ের আর্জি এমনকি মায়ের মান্নত সবই সন্তানের জন্য নিবেদিত হয় ওমোঘ মঙ্গলের ধারায়। সুতরূং -মাতাই জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রী।
পরিশেষে এ জগৎ সংসারের নির্মম বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে যোগমায়া আর মহামায়ার টানাপোড়েনে জীবন ও মৃত্যুর যুগ সন্ধিক্ষণে আমার প্রয়াত বা স্বর্গীয় মা’ এর স্মৃতি রোমন্থন করা যে কত কাষ্টের সেকথা বলার ভাষা আমার নেই। তবুও মানুষ আশা-নিরাশার দোলাচলেই জীবনকে বয়ে বেড়ায়। এই আমিও তাদের একজন।

(লেখক: প্রবন্ধকার, কলামিষ্ট, গল্পকার, কবি, সাহিত্যিক)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here