” সেকাল একাল, আশ্চর্য্য মিল “
সরওয়ারুজ্জামান মনাবিশ্বাস
দেশের স্বাধীনতার পর অর্থ্যাৎ ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমাদের এই বাংলাদেশটি ছিল কালোবাজারীদের অভায়ারন্য। এ দেশের মানুষের জীবন পরিচালনার চাহিদার অর্থ্যাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যই কালোবাজারীতে এ দেশে আসত। সম্ভবত চাউল আটা সেই তালিকার বাহিরে ছিল। অবশ্য এর যুক্তিসঙ্গত কিছু কারনও ছিল। কারনটি আলোচনা করতে গেলে অনেক রাজনৈতিক বিষয় আলোচনা করতে হয় কিন্তু সে সময় এখন নয়। তৎকালিন সময়ে অনেক কিছুর মধ্যে সব ধরনের কাপড়ের কালোবাজারই বেশী হত।আর এই দেশ থেকে যেত সোনা,রুপা, কাঁসা পিতল, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি। সে সময়ও সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করত বিডিআর যা বর্তমানের বিজিবি। কালোবাজারীরা হয় বিডিআর ম্যানেজ করে অথবা তাদের চোখ ফাঁকী দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে মালামাল নিয়ে এসে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মুল বাজারের দুই চারটা দোকান এবং আলাদা মার্কেট তৈয়ারী করে সে সব মালামাল বিক্রয় করত। আমার ধারনা ঈশ্বরদীতেও এ ধরনের নির্ধারিত মার্কেট ছিল। তখন প্রশাসনের সংগে কালোবাজারীদের অর্থ্যাৎ উভয়ের স্বার্থরক্ষার সেতুবন্ধনের জন্য স্থানীয় দুই একজন হোমড়া চোমড়া দুতিয়ালী করত। তারা কালোবাজারীদের নিকট থেকে চাঁদা তুলতেন তা থেকে প্রশাসনকে দিতেন এবং নিজেরা রাখতেন। এই ভাবে যখন তারা প্রচুর কালোটাকার মালিক হয়ে যায় তখন তারা একদিকে প্রশাসন অন্যদিকে ধীরে ধীরে রাজনীতিও নিয়ন্ত্রন শুরু করে। রাজনীতিতে কালোটাকার মালিকদের অন্তর্ভুক্তি,পদচারনা কিংবা নেতৃত্বে আসার প্রক্রিয়াটা কিন্তু তখন থেকেই শুরু হয়। তা ডালপালা মেলে কিভাবে সমাজ, রাজনীতি এমন কি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় হর্তা কর্তা হয়ে গেলেন তা লিখতে গেলে পাঠকদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে তাই মুল আলোচনায় আসি।
কালোবাজারীদের কিন্তু একটা সমস্যা ও বিপদ ছিল। মাঝে মধ্যে নিকটস্থ ক্যাম্প থেকে বিডিআর এসে তাদের দোকানের এবং গোডাউনের মালামাল নিয়ে চলে যেত অথবা কোন কোন সময় স্থানীয় কাষ্টম অফিসে জমা দিলে কাষ্টম অফিস তা নিলামে বিক্রয় করত। ঐ নিলামের কাগজটিও পরবর্তীতে কালো ব্যবসার একটি হাতিয়ার হত। বিডিআরদের এই ঝামেলাও চলত আবার ব্যাবসাও চলত। এখন অবশ্য কালোবাজারীর প্রচলন খুব একটা নাই। এটা বন্ধ বা কমে যায় একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। সেটাও এখানে আলোচনা করার সময় বা সুযোগ নাই।
কালোবাজারীদের ঐ ঘটনার সাথে হালের কিছু ঘটনার মিল মনে হচ্ছে।
চীন দেশে করোনা ভাইরাসে সংক্রমন এবং তা ভয়াবহ সহ বিভিন্ন দেশে সংক্রমিত হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগন সহ বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যাক্তিগন দেশের ঝুঁকির বিষয় বারংবার সতর্ক করেছেন। হয়ত বা সেই কারনেই চীন থেকে প্রথম দিকে চীন থেকে বেশ কিছু ছাত্রের দেশে আসার সুযোগ দিলেও পরবর্তীতে প্রায় বিশ জন ছাত্রকে চীন থেকে আসার ব্যাপার সরকার অনাগ্রহ দেখিয়েছেন। অথচ আমরিকা ইউরোপে যখন রোগটির চরম প্রাদুর্ভাব এবং মৃত্যুপুরী তখন সেখানকার প্রবাসীদের বাংলাদেশে আসার অবাধ সুযোগ দিলেন। বিমান বন্দর বা স্থল বন্দর সমুহে আগত প্রবাসীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা গুরুত্ব দিয়ে করা হয় নাই বলে বিস্তর অভিযোগ আছে। হোম কোয়ারন্টিনে অথবা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের কথা বললেও তা কতটুকু করল তা সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ তত্বাবধানও করা হয় নাই। কিন্তু কয়েক জন রুগী করোনা শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এবং একজনের মুত্যু হওয়ায় দেশব্যাপি ভয়াবহ আতংকের সৃষ্টি হলে সরকার নড়েচড়ে বসে। দেশে আসা প্রবাসীদের সঙ্গনিরোধে অনেক বেশী গুরুত্ব দেন। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা এমন কি সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঘটনাটা অনেকটা বিডিআর আর কালোবাজারীর ঘটনার মত অর্থ্যাৎ ছেড়ে দিয়ে তেড়ে ধরার প্রচেষ্টা। তাও যে খুব কার্য্যকর হচ্ছে তাও মনে হচ্ছে না। ব্যাপারটা এই রকম যে, দৈত্য রাখা বোতলের ছিপি খুলে দেওয়াতে দৈত্য বের হয়ে যখন জনপদ ধ্বংশ করছে তখন তাকে ধরতে জ্বীন পরী চালান দেওয়া হয়েছে। উপরন্ত ইটালি থেকে কোন বিমান নিষিদ্ধ থাকা সত্বেও সম্ভবত গত ১৬/৩/২০ তারিখে কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানে ৯৫ জন যাত্রী ঢাকায় অবতরন করেছেন যদিও শুনেছি তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার কর্মচারীদের গ্রামের বাড়ী যাওয়ার সুযোগ বহাল রেখে সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ছুটি ঘোষনা জনমনে নতুন শংকার সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে বর্তমান ঘটনা প্রবাহে সরকার অস্থিরতায় ভুগছে। কোন কাজই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এবং সুপরিকল্পনা নিয়ে করতে পারছেন না। অন্যদিকে প্রায় তিন মাস সময় পাওয়ার পরেও সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যখন পত্রিকায় দেখা যায় সেবাদানকারী ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় পিপিই,মাস্ক অপ্রতুল, প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গনিরোধের স্থান নির্ধারিত নেই যতটুকু আছে তাও মানুষের বসবাস করার মত নয় বলে অভিযোগ। তা নিয়ে একটি অনাকাংখিত ঘটনাও ঘটে গেছে। আর জনগনের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হেক্সাসল তো বাজারেই নেই। পত্রিকা বা টিভিতে দেখা যায় বিশ্বের দেশে দেশে করোনাকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। চীন, ইটালি, স্পেনে মুসলমানদের সংগে জাতীগত বিরোধ, সাম্প্রতিক কালে ভারতের ঘটনায় জনগনের যে রক্তক্ষরন তা ভুলে তারাও করোনা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ। আবার কোন ভাবে সংকট মোকাবেলা করা গেলেও তারপরে বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিবে তার মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নাই। অথচ সেখানে বাংলাদেশে কি ঘটছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের হিংসা আর বিদ্বেষপুর্ন বক্তব্যে সমগ্র জাতী যেন কুল কিনারাহীন হতাশার সাগরে ভাসছে। যদিও আজকে সরকার দয়াপরবশ হয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য দন্ড স্থগিত করে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অত্যান্ত ভাল সিদ্ধান্ত। এ জন্য আমি সরকার এবং সরকার প্রধানকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ জানাই। আমি মনে করি জাতীয় ঐক্যমত্য সৃষ্টির পথে সরকার এক ধাপ এগিয়েছেন। বাকীটুকু আজকের সরকার প্রধানের জাতীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষনে খোলাসা করবেন ইনশে আল্লাহ। আমার বিশ্বাস জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হলে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিনে থাকা কিংবা জনসচেনতা সৃষ্টির জন্য পুলিশ, মিলিটারী বা প্রশাসনের প্রয়োজন হবে না, সচেতন জনগন অনেক বেশী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। হিংসা বিদ্বেষ, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ এবং জাতীর এই মহাদুর্যোগে কোন বিভাজন নয় শুধু ঐক্য প্রয়োজন, ঐক্যই এখন সময়ের দাবী। আমার ধারনা জনগন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক বক্তব্য এবং নির্দেশনার জন্য একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। সবশেষে আহবান, মহান মালিকের উপর ভরসা রাখুন, কোন ভাবেই আতংকগ্রস্থ হবেন না, মনোবল অটুট রাখুন, করোনা সংক্রান্ত সকল বিধি নিষেধ মেনে চলুন, সঙ্গনিরোধ ও সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করুন, খুব বেশী প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না, বাড়ী ঘর সহ সবাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন, বারংবার সাবন দিয়ে হাত ধুয়ে নিন এবং করোনা সংক্রান্ত ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করুন।
লেখকঃ কলামিষ্ট এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মেইল- mb3192279@ gmail.com
মনা ভাই খুবই সুন্দর ভাবে সবকিছু উপস্থাপন করেছেন। আমার মনে হয় এই লেখাটি যথোপযুক্ত এবং সময় উপযোগী। মনা ভাইয়ের অনেক লেখার মাঝে এই লেখাটি সত্যিই চমৎকার। লেখাটিতে ভাষার ব্যবহার, তথ্য এবং করণীয় বিষয় গুলি সত্যিই সমাজ বিশ্লেষকের পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে মনা ভাই। আরো ধন্যবাদ আমার বন্ধু লুলুকে। যে লিখাটি তার অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ করেছে।