দুঃখবিলাসী
—–আওলিয়া খানম টুলটুল
কি হল? অনেকক্ষন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করেই যাচ্ছি । তুমি তো জান আমি হাঁটতে পারিনা । জেনেশুনেই আমাকে বিয়ে করেছো ।
এখন একটু হুইলচেয়ারটার পাশে এসে দাড়াও ।
আহা এভাবে বলছো কেন ?
তুমি যেমনই হওনা কেন তাই নিয়েই আমার ভালবাসা।
তোমার একটা সুন্দর কবি মন আছে আমি সেটাকেই ভালবাসি,আজন্ম ভালবেশেই যাবো কবি বললো বুঝলাম,আচ্ছা ঠিক আছে ।
এখন একটু বারান্দায় নিয়ে যাও আকাশ দেখবো । ঘরে থাকতে থাকতে মন বিষিয়ে উঠছে ।
কতক্ষন বারান্দায় থাকার পর কবি বললো, আচ্ছা আমাকে কি একটু ছাদে নিয়ে যেতে পারবে? কতকাল ছাদে যাইনি । মৃত্যুর আগেই আমি অনেকটা মৃতমানুষ হয়ে গেলাম ।
অহনা বললো , কি যে বলনা তুমি । কেন এভাবে বলো,আমি সইতে পারিনা। আমি কি একবারও বলেছি যে পারবোনা ? অবশ্যই পারবো একশতবার পারবো এবং এখনই নিয়ে যাবো ।
কবি অনেকখানি আবেগে আপ্লুত হয়ে অহনার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি এমন এক সময়ে আমার জীবনে এলে, যখন আমার জীবন যৌবন সব বিধ্বস্থ । পরিবার বলতে কিছু নেই ।
আমার দুঃখের দিনে সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।
কেনইবা তুমি আমার ুদুঃখের দিনে সাথী হতে এলে?
তাইতো আমি বলি ওগো আমার দুঃখবিলাসী আমি তোমায় অনেক ভালবাসি। তোমায় আমি সত্যি ভালবাসি।
অহনা বললো, জানিগো জানি সব জানি সেজন্যই সবার অমন চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে আমি তোমার কাছে চলে এসেছি ।
অহনা মনে মনে ভাবছে অন্যকথা। ভাবছে এই লোলা ল্যাংড়া বুইড়াটাকে কোনরকমে ম্যানেজ করে ওর টাকা পয়সা কিছুু হাত করতে পারলে একেবারে ওটাকে ফেলে চলে যাবো ।
অহনার প্রয়োজন ছিল টাকা। কিন্তু বাড়ীর বাজার থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ করে কবি সুমন এর এক আত্নিয়ের ছেলে । কবি সুমনকে সে কাকা বলে ডাকে । তাকে দিয়েই সে ব্যংকের টাকা তোলা ও অন্যান্য কাজ করায়। সে খুবই বিশ্বস্থ ।
অহনা ভাবে যার জন্য এই বুইড়াকে বিয়ে করলাম, তারা কানাকড়িও জুটলোনা ।
কবি শুধু বলে তুমি ভেবোনা,আমি আমার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির একটা অংশ তোমাকে দিয়ে যাবো ।
অহনা শুনে হেসে বলে আমি কি তোমাকে বিয়ে করছি না তোমার সম্পত্তি টাকা-পয়সাকে বিয়ে করেছি ? এসব কি বল তুমি ?
কবি উত্তরে বলে, দেখো মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন ভালবাসা দরকার তেমনি সহায়- সম্বলও দরকার ।
আমি কি তোমাকে খালি হাতে রেখে বিদায় নিয়ে চলে যাবো?
তুমি কি তাই মনে করো ?
তোমাকে বিদায় দিচ্ছে কে? আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে কোথাও যেতে দেবোনা ।
কবি হেসে বলে আমার আর তোমার বয়সের পার্থক্য কত জানতো নিশ্চয়?
তুুমি যাতে করে একটা সুন্দর জীবন-যাপন করতে পারো তার ব্যবস্থা আমি করে যাবো ।
এ নিয়ে তুমি একটুও ভেবোনা ।
চল ছাদে যাই.ওখান থেকে ফিরেই চা খাবো তারপর একসাথে বসে টিভি দেখবো, রাতের খাবার খাবো । তারপর..
তুমি না ভীষন দুষ্টু ।
কবিরা এমনই হয় ।
মাঝে মাঝে অহনার মায়াও হয় ষাটোর্ধ একটা লোককে তার পরিবারের কেও দেখেনা ,সবাই তাকে ফেলে চলে গেছে । সেই বা আর কয়দিন বাঁচবে কে জানে।
আর কটা দিন যাক ওটাকে কিছু খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমি সব নিয়ে চলে যাবো । এই লুলা ল্যাংড়ার সাথে কে জীবন পার করবে?
হাঁটতে পারেনা ঠিকই, কিন্তু রাতের বেলায় তার মাথা নষ্ট হয়ে যায় সে অহনাকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে অস্থির করে ফেলে । একটা রাতও বাদ যায়না ।
এছাড়া দিনেও মাঝে মাঝেই দুপুর বেলা বলে চল শুই । তার শোয়া মানেই অহনাকে ঝাপটে ধরে থাকবে । অহনাকে কোন কথাই বলতে দেয়না । কবি সুমন বলে আমি তো তোমাকে বিয়ে করেছি আমার ও তোমার সুখের জন্য । সুখটুকু আমাকে তুমি দেবেনা?
অহনা আর কিছু বলেনা । জড়িয়ে ধরে আর বলতেই থাকে অহনা এই অহনা । তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেনাতো?
আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি ।
অহনা ভাবে হুম ,ভালবাসা ! ও শুধু শরীর চায় ।
কবি সুমন ভাবে আমি তাকে ভালবেশে বিয়ে করেছি । হোকনা বয়সের ফারাক তবুতো শেষ বয়সে একটা অবলম্বন পাওয়া গেলো ।
পাঁচ মাস হলো তাদের বিয়ে হয়েছে, কবি সুমনের আগের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন। সন্তান নাতি নাতনী সব থাকে দেশের বাইরে ।
এরই মধ্যে একদিন অহনা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো,কাজের বুয়াটা মাথায় পানি দিল মুখে পানির ছিটা দেওয়ার পর বললো, আম্মা আপনের কি খারাপ লাগতেছে? এরই মধ্যে অহনা দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে বমি করতে শুরু করলো ।
কবি সুমন হুইল চালিয়ে এগিয়ে বললো, ময়নার মা অহনার কি হলো?
ময়নার মা মুচকি হেসে চলে গেলো, বললো আম্মার মনে হয় খবর আছে
কবি সুমন বললো, কিসের খবর ।
আপনে খালুজান মনে লয় আবার বাপ হইতে যাইতাছেন ।
কি বল তুমি এসব?
আম্মারে ডাক্তারের কাছে নেওন লাগবো,তয় জানা যাইবো কি ঘটনা ।
অহনা ডাক্তারের কাছে গেলো ঠিকই কিন্তু সে ডাক্তারকে বললো এই বাচ্চা আমি রাখবোনা । সে একাই গিয়েছিলো ডাক্তারের কাছে । ডাক্তারের কাছ থকে ফেরার পর সুমন জিজ্ঞাসা করলো কি খবর ?
অহনা বললো, টেষ্ট করতে দিয়ে এসেছি।
রিপোর্ট কাল আসবে ।
আগামীকাল জানা যাবে ।
পরদিন রিপোর্ট আনতে অহনা একাই যেতে চাইলে কবি সুমন বললো, আমিও যাবো তোমার সাথে । অহনা কিছুটা ভড়কে গেলো।
এখন আর কিছু করার উপায় নেই ।
দুজনে মিলেই গাড়ীতে করে গেলো, জানাগেলো অহনা মা হতে চলেছে । কবি সুমন দারুন খুশী । কারন তার আগের সন্তানরা কেও তার সাথে নেই । একটা বাচ্চা আসলে বাড়ীটা আনন্দে ভরে উঠবে, খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে ,ভাবতে ভাবতেই ফেরার পথে কবি সুমন ফিক করে হেসে দিল ।
অহনা জিজ্ঞেস করলো, কি হলো হাসছো কেন?
সুমন বললো ভাবছি তোমার সন্তান কিভাবে হাসবে খেলবে এসব ভাবছিলাম ,ভাবতে ভাবতেই মনটা খুশীতে ভরে গেলো ।
সন্তানটা কি আমার একার ও তো তোমারও ।
ক্রমে ক্রমে দিন চলে যাচ্ছে অহনার শরীর ভারী হয়ে উঠেছে আগামী মাসেই বাচ্চা প্রসবের তারিখ ।
একটা ছোট্র বাচ্চার আসার উত্তেজনায় কবি সুমন প্রচন্ড উৎসাহিত বোধ করছে ,তার মনে হচ্ছে এটা শুধু অহনার নয় তারও প্রথম সন্তান ।
যথাসময়ে একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তান প্রসব করলো।
আশ্চর্য হলেও সত্যি হলো সেই তখনই হঠাৎ কবি সুমন হুইল চেয়ার থেকে ক্ষনিকের জন্য দাড়িয়ে গেলো ।
এখন আর অহনা অন্য কিছু ভাবছেনা । ভাবছে ছেলে যখন হয়েই গেছে এখন তো তার অধিকার সে বুঝেই নেবে বা কবি দিয়েই যাবে ।
সকাল বিকাল সন্ধ্যা কবি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর একটু পর পর বলে একটু আমার কাছে দাও ।
অহনা এখন খুব সুখী একজন মা ।
সে সন্তানের ভবিষ্যৎ ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবছেনা ।