বাঙালির প্রাণের উৎসব
বনশ্রী রায় দাস
আবির ছুঁয়ে নানা রঙে সেজে উঠেছে প্রকৃতি । নরম পাতায় পাখি কাকলি ফুলের উৎসবে রংবাহারি হিরে মতি খেলায় মগ্ন আকাশ নেমে স্নান সারে হৃদি- উপত্যকায় । মেঘদূতের হংসমিথুন পাখায় নতুন দিনের কলমকারি ।
বাংলা সন বা বাংলা বর্ষপঞ্জি একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত সৌর পঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি ।সূর্যোদয়ের সঙ্গে সৌরদিন গণনা করা হয় ।
খুশির হিরকদ্যুতি মুখরিত আনন্দ নদীর পায়ে পায়ে চন্দ্রাবতী ঘুঙুর । এসবের ভিতর দিয়ে মনের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়তে চায় আনন্দ প্রপাত খুশির খুশবু মাখামাখি হাওয়া মৃত্তিকার এলোচুলে পরিয়ে দেয় ঋতুকুসুম।অকৃত্রিম ছলাৎ নিয়ে সমুদ্র সৈকতে কানাকানি নতুন ঢেউ উপহার দিয়ে যায় মোহনার ইশারায়। মাঠ জেগে থাকে নিয়ে খুশির খবর । কথায় বলে ” বৈশাখের প্রথম জলে / আশুধান দ্বিগুণ ফলে।
সুতরাং ঘরে বাইরে সর্বত্রই খুশির খবর হয়ে আসে এই পহেলা বৈশাখ মানুষের যাপন
শৈলীতে ।আহ্নিকগতির দিনরাত গুনতে গুনতে মাস বারোমাসে পৌঁছে যায় বার্ষিকগতির দুয়ারে আবার একটি বঙ্গাব্দ । বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ । বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হিসেবে বিবেচিত একটি বঙ্গাব্দের শুভ সূচনা আবার নতুন পঞ্জিকা ।
বাঙালি উৎসব প্রিয় তাই বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ । বৈশাখ থেকে চৈত্র এই বারোটি মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রের নামে। বিশাখা নক্ষত্রের নামে বৈশাখ এবং এই বৈশাখ মাস দিয়েই শুরু হয় সারা বছরের পথচলা। এই দিনটি তাই সমগ্র বাঙালির কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । নববর্ষ উদযাপনের ঢেউ দোলা দিয়ে যায় হৃদয়ে ।নবজন্ম বা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার উদ্দেশ্যে পালিত হচ্ছে এই দিনটি বহু যুগ ধরে ।পুরাতন জীর্ণ অস্তিত্বকে বিদায় জানিয়ে নব উদ্যমে নব উৎসাহে সতেজ সজীব জীবনকে আহ্বান জানানোর জন্য চিহ্নিত করা হয় ।
এই উন্মাদনায় কবির কলম ও বেজে ওঠে ঝংকৃত বীণার মতো । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন
” বীণাতে হানো হানো খরতর ঝংকারঝঞ্ঝা ।তোলো উচ্চ সুর নির্দয়াঘাতে ঝর্ঝরিয়া ঝরিয়া পড়ুক প্রবল প্রচুর । ধাও গান, প্রাণভরা ঝড়ের মতন উর্দ্ধবেগে অনন্ত আকাশে উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা বিপুল নিঃশ্বাসে ।”
এই অন্যতম জাতীয় উৎসব উদযাপনকে স্বার্থক করতে নানাবিধ আয়োজন
উৎসব প্রিয় বাঙালির ।ছোটবেলা থেকে দেখেছি আমাদের সবুজ আস্তিনে মোড়া ছোট্ট গ্রামের নববর্ষ উদযাপন । বাড়ির গুরুজনদের তৎপরতা।পয়লা বৈশাখে কাকভোরে উঠে আমাদের ঠাকুরদা ঘর ও বাগান পরিষ্কারের সমস্ত আবর্জনা পুড়িয়ে দিতেন । ঝকঝকে তকতকে হয়ে যেত চারপাশ । ঘুম জড়ানো চোখের পাতা খুলে বয়ে যেত অন্য সকালের শুভেচ্ছা চারপাশে ছড়িয়ে থাকা গন্ধরাজ, গোলাচ, বেলি, শিরীষ ফুলের মাতাল করা সুগন্ধ বাতাস বয়ে যেত কানের ঝুমকো হয়ে । কৃষ্ণচূড়া লাল ওড়না গায়ে রাঙা হয়ে যায় নতুন বউয়ের ঠোঁটে।ছোট্ট চম্পা নদী মেঘ-পালক হয়ে ছুটে যায় নোলকে । মনের ক্যানভাসে স্রোত নেমে আসে আকাশের । সকাল সকাল সবাই স্নান সেরে সামর্থ অনুযায়ী নতুন পোশাক পরতাম আমরা সবাই। বিশেষ করে বাড়ির ছোট সদস্যরা । মা, ঠাকুমা বাড়ির প্রবেশ দরজার সামনে আলপনা দিয়ে বসিয়ে দিতেন মঙ্গলঘট ।পেতলের জলপূর্ণ ঘটে নতুন আম্রশাখায় সিঁদুর দিয়ে ঘটে এঁকে দিতেন স্বস্তিক । সুন্দর একটি আধ্যাত্মিক রোদ ছড়িয়ে পড়তো ঘরময় । পুজোপাঠ শেষে আমরা ছোটরা যেতাম পাশাপাশি বাড়িতে প্রসাদ বিতরণ করতে। সবটা মিলিয়ে একটা সাজো সাজো রব । তারপর নিরেমিষ রান্না হতো সেই দিনটিতে অনেক পদ পরমান্ন পিঠে পুলি সহযোগে । আমন্ত্রিত অতিথি আসতেন । ঠাম্মা বলতেন বছরের প্রথম দিন ভালো কাটলে বছরভর ভালো ভাবে যাবে । যাইহোক আমরা দাদা ভাই বোনেরা খুব আনন্দ করতাম। বিকেলে হালখাতা দোকানে নিমন্ত্রণ রক্ষা, সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকতো কচিকাঁচাদের নাচ গান আবৃত্তি বড়দের নাটক ইত্যাদি ।
এসো হে বৈশাখ এসো ,এসো ,
গান সাধারণত থাকতো অনুষ্ঠানের সূচনা পর্বে
কালচক্রের নিয়মে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে এখন ও আসে নববর্ষ কিন্তু সেই উৎসবের আমেজে সেই জৌলুসের বহুমাত্রিকতায় ভাটা পড়েছে অনেকখানি । এখন ডিজিটাল দুনিয়া সদা ব্যস্ত, আনন্দ যজ্ঞে ব্যয় করবার মতো সময় কিংবা আকর্ষণ কোথায় ? নেই বছরের প্রথম দিনটিকে কেন্দ্র করে বাঙালির হৃদিকোণের আবেগ জড়িত উচ্ছ্বাস। অনু পরিবারে অভ্যস্ত মানুষ বেশিরভাগ স্মার্ট ফোনে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেন। কেউ কেউ মন্দিরে পুজো দিয়ে দোকানের হালখাতা উদ্বোধন করেন কোনো বাড়িতে লক্ষ্মী গণেশ আরাধনা হয়তো পারিবারিক ব্যবসা জনিত প্রতিষ্ঠানের শুভ কামনায় । অনেক জায়গায় মেলা শোভাযাত্রা ইত্যাদি হয়ে থাকে ।
এই দিনটি কিন্তু আমাকে নিয়ে যায় আমার সেই শিশির ধোয়া মনি মুক্ত ফুটে ওঠা স্মৃতির কাছে । আমি ও সকাল সকাল স্নান সেরে জলপূর্ণ ঘট সাজাই ঠাকুর ঘরের ঈশানে ।
জল জীবনের প্রতিক সদ্য গজিয়ে ওঠা আম পাতা হৃদয় মন ভিজিয়ে নিয়ে আসে সরল স্নিগ্ধ দিগন্তপুর । লাল পেড়ে আলতা সিঁদুরে আমি নিজেই কেমন ” মা ” হয়ে উঠি। পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেশের মঙ্গল কামনা করি ঈশ্বরের কাছে । চৌদ্দশ আঠাশের
শুভারম্ভ হবে হয়তো একটু অন্যরকম অতিমারি কারণে বাইরে উৎসবের ভাগিদার হতে পারব না । পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক দ্রুত মানুষের দুরবস্থার দুঃখ যন্ত্রণা ধুয়ে যাক মঙ্গল ঘটের শান্তি জলে।
সকল বেদনা যন্ত্রণা ভুলে কবি নজরুলের ভাষায় বলবো
” তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর !
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
কালবোশেখির ঝড়।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর “।
নতুন করে খুঁজে নিতে ভালো থাকার পথ কবি
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথায়
” এখানে বৃষ্টি মুখর লাজুক গাঁয়ে
এসে থেমে গেছে ঘড়ির কাঁটা ,
সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে
পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা ।”
নতুন দিনের নতুন পথের সন্ধানে ভালো থাকবার ওষধি সন্ধান করতে নব রূপে আসুক নববর্ষ শুভ হোক সকলের ।