নারীশক্তি
ডাক্তার রীতা ওঝা
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। সমাজ, দেশ ও জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারী শুধু এখন পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনার মাঝে ব্যস্ত থাকে না, অফিস-আদালতসহ বাইরের পৃথিবীও তাকে সামাল দিতে হয়। নারীও এখন এক বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি। কিন্তু পদে পদে তাকে মোকাবেলা করতে হয় ঘর ও বাইরের অনেক বাধা। তাকে পেরিয়ে যেতে হয় অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ।
যুগ যুগ ধরে চলে আসছে মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য নিরন্তর ছুটে চলা। সময়ের সাথে সাথে নারী ও পুরুষের প্রায় সমান তালে চলছে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী কাজ। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা আছে বললে মনে হয় ভুল হবে না। কারণ শুধু অফিসের টেনশন মাথায় নিয়ে থাকলে হয় না, সাথে রাখতে হয় সংসারের বিভিন্ন কাজের চিন্তা, ছেলেমেয়ে, স্বামী, আত্মীয়স্বজন ও নিজের। তবে পৈতৃক ভিটার জীবন থেকে শ্বশুরবাড়ির জীবনটা… শুনতে অপ্রিয় হলেও ভিন্ন ধরনের । শ্বশুরবাড়ির পরীক্ষাতে আনন্দ পেতে একটু কষ্ট হয় বৈকি। কথায় বলে ‘ত্যাগেই শান্তি’, এটার সাথে ধৈর্য্য ও প্রকাশ করতে হয়। তবে নারীর সার্থকতা আমার কাছে মনে হয়- সুশিক্ষা, ভালো চাকরি, সুন্দর মনের মানুষের সাথে জীবন কাটানো আর ভালো মা হবার সাধ।
কথায় বলে শিক্ষা চলে মায়ের কোল থেকে কবরের আগ পর্যন্ত। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলে পিতা -মাতার কাছ থেকেই শুরু হয় স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা। তারজন্য করতে হয় প্রতিনিয়ত যুদ্ধ। সবদিক ম্যানেজ করে নিজের কাজ করতে হয়, তা নাহলে চলে সমালোচনা। কখন যে সময় চলে যায় বলা কঠিন। পুরুষের বেশিরভাগ সময় কাটে বাইরের কাজে। তবে আমরা এটাও জানি..’Duty always causes pain’. নারীদের কর্তব্য ও দায়িত্বের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেই নেপোলিয়ন বলেছিলেন… ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি দিব’।
শুরু হলো সৃষ্টির রহস্য। সৃষ্টির বিকাশ ও নির্মাণ প্রেম দিয়ে, সংহার দিয়ে নয়। দায়িত্ব আর ভালোবাসা দিয়েই সৃষ্টিকে আগলে রাখতে হয়। সেখানে নারী ও পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন…
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তাঁর নর’।
কিন্তু অধিকাংশ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয় নারীকেই। তারজন্য যত দুঃখ-কষ্ট আসুক না কেন, সবই মাথা পেতে নিতে হয়।
সময়ের সাথে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অসাধারণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। সর্বত্রই আছে নারীর পদচারণা। সৃষ্টির রহস্য থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্রে, অফিস আদালতে, সংস্কৃতি চর্চায়, ক্রীড়াক্ষেত্রে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, দেশশাসন ও পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ে রয়েছে নারীর অসমান্য অবদান। নিজের সুখের মাঝে ডুবে না থেকে সমস্ত পরিবারের কথা তাকে ভাবতে হয়।
ছোটবেলা থেকে অ-যুক্ত শব্দ অনেক শুনে আসছি। বাংলা ‘অ’ উপসর্গ নিন্দিত অর্থে ব্যবহৃত হয়। যখন বুঝতে পারলাম, তখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচিত ‘বর্ণপরিচয়’ এর কথা ভাবলাম। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখলাম যে, সমস্ত নিন্দনীয় শব্দ মনে হয় নারীর জন্য। কাজ ঠিকমতো না পারলে অকর্মণ্য, অকেজো, অদক্ষের পরিচিতি; প্রবাদের ভাষায়.. ‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। শিক্ষার অভাব থাকলে অশিক্ষিত, মূর্খ, নির্বোধ মেয়ে এসে জুড়ে বসছে আমাদের কাঁধে; পরিবারে শান্তি না থাকলে অশান্তি, অমঙ্গলের ছোঁয়া লাগছে ঘরে; অশুভ,অকল্যাণ নিয়ে আসছে। সতীত্ব হারিয়ে গেলে অসতীকে ঘর থেকে, সমাজ থেকে বের করে দেও; অপঘাতে কাউকে হারিয়ে ফেললেও অভাগী, পোড়াকপালী কেন যে আমার ঘরে আসলো; দারিদ্রের মাঝে দিন কাটলে অলক্ষ্মী মেয়ে; সুন্দরী না হলে বা কাজ সুন্দর না হলে জন কিটসের কথাকে (Truth is beauty, beauty i’s truth) সত্য বলে প্রমাণ করতে চায়, যেটা অসুন্দরী নারীর জন্য কষ্টদায়ক। সন্তান জন্ম দিতে না পারলে অপয়া, বন্ধ্যা অনেক অনেক অসম্মান, অপমান, অবজ্ঞা, অবহেলা, অন্যায় কথা। ধৈর্য্য ও ত্যাগ, ক্ষমতা, সাহস ,শক্তির বিনিময়ে সংসারে শক্ত হাতে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে কমবেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
কিন্তু তবুও এই সুন্দর ধরণীতে সৃষ্টি করার বা ধরে রাখার জন্য, সেবা করা বা দেয়ার জন্য, কথা শোনার জন্য, দুঃখ-কষ্ট, দুর্দশা সহ্য করার জন্য বলা যায় নারীই পৃথিবীতে ক্ষমতা বান(woman is the power of the world)। তাই আমরা নিন্দিত শব্দগুলি নতুন সৃষ্টির কাছে ভিন্ন উপায়ে উপস্হাপন করি তাহলে সবার জন্য সুন্দর।
নারী যেন পায় যোগ্য সম্মান। নারী হয়ে উঠুক শান্তি, ভরসা ও শক্তির উৎস। তাই সমাজকে ,দেশকে ,জাতিকে মাথায় রাখতে হবে…
“নারীর গর্ভে জন্ম সবার
নারীকে করেছে সাথি,
দুঃখ, কষ্ট সয়েও নারী
আঁধারে জ্বালায় বাতি”।
লেখকঃ – প্রভাষক ,ফিজিওলজি ও বায়োকেমিষ্ট্রী ডিপার্টমেন্ট , ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, মিরপুর,ঢাকা