জীবন বোধের কবি লেখক-নাসরিন জাহান মাধুরী এর বিশ্লেষণ ধর্মী অসাধারণ লেখা “আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস”

571
জীবন বোধের কবি লেখক-নাসরিন জাহান মাধুরী এর বিশ্লেষণ ধর্মী অসাধারণ লেখা “আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস”

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস

                                   নাসরিন জাহান মাধুরী

“নারী নির্যাতন প্রতিরোধ “—কথাটি যতটা সহজে বলা যায়, কাজটা কিন্তু ততোটা সহজ নয়। এইযে নারীরা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে, অবহেলিত হচ্ছে, এগুলো একদিনে হয়নি। আর কোন বিশেষ দিন পালন করে নয় আমাদের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা না গড়ে ওঠলে এই নির্যাতন প্রতিরোধ কোন কালেই সম্ভব নয়।

নারী নির্যাতনের মূল কারণ যদি আমরা চিহ্নিত করতে চাই, তা হলে দেখি নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষমতার কাঠামোয় নারীর অধস্তন অবস্থান ও নারীর ব্যক্তি অধিকারের অস্বীকৃতি।
এসবের পেছনে রয়েছে পুরুষত্ব (Masculinity)। সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট জেন্ডার ধারণার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আগ্রাসী পুরুষত্ব মনোভাব। জন্মের পর শিশুকে সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে নারী ও পুরুষ হিসেবে তৈরি করা হয়। পুরুষের মধ্যে নারীকে হেয় করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।

শিক্ষাঙ্গনের দিকে যদি তাকাই, দেখা যায় মেয়েরা অনেকটাই এগিয়ে থাকে মেধায়, মননে, সৃজনশীলতায়। অনেক ভালো রেজাল্ট। অনেক দক্ষতা নিয়েও সময়ের সাথে সাথে মেয়েরা হারিয়ে যেতে থাকে। তাহলে এই মেয়েগুলো কোথায় যায়? যায়না কোথাও। ওরা তখন সংসার নামের শৃঙ্খলে বন্দী। অনেক মানসিক নির্যাতনের সাক্ষী সেইসব নারী।

আবার অনেক ক্ষেত্রে নারী শৃঙ্খল ভেঙে হয়তো বেরিয়ে আসে, নিজের আর পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ভেবে। সেখানেও থাকে পারিবারিক বিধিনিষেধ চোখ রাঙানী।

বিভাজনের শুরু সেই থেকেই। নারীরাও এই মানসিকতা নিয়েই বেড়ে ওঠে যে সে একজন নারী, সে দুর্বল। তাকে পুরুষের আজ্ঞাবহ হয়েই কাটাতে হবে জীবন।
মুষ্টিমেয় কিছু নারী পারে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে।
আর বাকী নারীদের কপালে থাকে একই বিধান হোক সে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, ফারাক নেই কোন।
তাই নারী নির্যাতন নির্মূলে চাই নারী-পুরুষের সমতার দৃষ্টিভঙ্গি।এই সমতার দৃষ্টিভঙ্গি কে তৈরি করবে? এই সমাজের নারীপুরুষ উভয়েরই দায়িত্ব সমতার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।
আর তা না হলে নারী পর্যদুস্ত ঘরে বাইরে — নির্যাতন চলে — মৌখিক, শারিরীক সব রকমের, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ বেড়ে চলছে ক্রমাগত।

১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে তৎকালীন বিশ্ব পেয়েছিল দুটি প্রত্যয়, নারীর অধিকার মানবাধিকার এবং নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু এতো বছরেও নারী নির্যাতন কি কমেছে আদৌ? বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
লিঙ্গভিত্তিক এই নির্যাতন নারী-পুরুষের বৈষম্যের একটি বর্বর প্রকাশ। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি এই সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্যি, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নানা পন্থায় নির্যাতন চলছে।
১৯৯৫ সালে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং কর্মপরিকল্পনা ও ঘোষণার ১২টি উদ্বেগপূর্ণ ক্ষেত্রের একটি ছিল ‘নারী ও সহিংসতা’। সেখানে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা যেমন হরণ করে, তেমনি এই অধিকার ক্ষুণ্ন ও বাতিল করে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা সেই ধরনের তৎপরতা, যার ফলে নারীর শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি বা বিপর্যয় ঘটে বা ঘটতে পারে। একই সঙ্গে এর দ্বারা বোঝানো হয় উল্লিখিত ধরনের তৎপরতা, দমন-পীড়ন বা স্বাধীনতা হরণের হুমকি, যা জনজীবন বা ব্যক্তিজীবন যেকোনো ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করা হয় বা হতে পারে।
১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নারী নির্যাতনবিষয়ক ঘোষণায় বলা হয়, নারীর অধিকারগুলো হবে : জীবনের অধিকার, সমতার অধিকার, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সম-নিরাপত্তার অধিকার, সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়ার অধিকার, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সেবা লাভের অধিকার, ন্যায্য ও অনুকূল কর্মপরিবেশের অধিকার, কোনো প্রকার নির্যাতন অথবা অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ অথবা অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আচরণ ও শাস্তি না পাওয়ার অধিকার। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলধারায় নারীকে যুক্ত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নারীর সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে মুক্ত হওয়া।

বাংলাদেশের নারী নির্যাতন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী যদিও কোনো একক সত্তা নয়, শ্রেণি, বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থানের তারতম্য থাকলেও সে নারী এটাই তার প্রধান পরিচয় এবং এ কারণে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। চার বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, আবার ৮০ বছরের বৃদ্ধাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নুসরাতের মতো মাদ্রাসার ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, আবার পেশাজীবী নারী রূপা গণপরিবহনে কর্মস্থলে আসার পথে বাস ড্রাইভার কন্ডাক্টর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মী মিতুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে রক্ষকদের দ্বারা। কখনো মা-মেয়ে একসঙ্গে ছেলের বয়সী তরুণ-যুবকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ নারী ধর্ষণের মতো বর্বর পশুত্বপূর্ণ নির্যাতনের শিকার। এখানে নির্যাতনকারীর মধ্যে রয়েছেন পরিবারের নিকটতম সদস্যসহ বাবা-চাচার মতো অভিভাবক, রয়েছেন শিক্ষক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, গণপরিবহনের কর্মী, এমনকি কোন নারী তার স্বামীর মাধ্যমেও এ হয়রানীর স্বীকার,যদিও স্বামী কর্তৃক হয়রানীকে সমাজের কাছে জায়েজ বলে স্বীকৃত ।
বর্তমান সময়ে নারী নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ ধরন হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। নারী নির্যাতনের কাজে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে।
নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ার নেই কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্র। নিজ গৃহ যা কি না হওয়ার কথা সর্বাপেক্ষা নিরাপদ, সেই গৃহে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে সর্বাধিকসংখ্যক নারী—৮০ শতাংশ। গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পথে-ঘাটে, যত্রতত্র নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনের কারণও হচ্ছে নানামুখী।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের চিত্রের পাশাপাশি নারীর অগ্রগতি ও অর্জনের পরিচয়ও রয়েছে। সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয়তা, রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, আগের তুলনায় নারীর সচেতনতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি এখন দৃশ্যগোচর। নারীর অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে নানা ধরনের নীতি, কর্মপরিকল্পনা, বিধান এবং সংবেদনশীল আইন। কিন্তু এসব অর্জন ও প্রাপ্তিকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে তুলছে নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও নির্যাতন।

আজ রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হলে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের কথা ভাবতে হবে। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলের জন্য সমন্বিত বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বুঝতে হবে নারী নির্যাতন ব্যক্তিগত ইস্যু নয়, জেন্ডার ও মানবাধিকার ইস্যু। এর জন্য নারী নির্যাতনের মূল কারণগুলো দূরীকরণে কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান জেন্ডার সংবেদনশীল আইনের প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন ও সংস্কার, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সুশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কাজে যত ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেন এর কোন সফল বাস্তবায়ন চোখে পরে না।
কোন নারী নির্যাতিত হলে, ধর্ষিত হলে সামাজিকভাবে তাকেই হেয় করা হয়।তার চলনের, তার পোষাকের ওপর আঙুল তোলা হয়। আসলে এসবই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। আর নারী নিজে যদি সচেতন না হয় কেউ তার হাতে অধিকার তুলে দেবে না। প্রতিরোধ নিজ থেকে না করলে নারী নির্যাতন বেড়েই চলবে।

আজকের দিনে আমরা শপথ নিতে পারি যুগ যুগ ধরে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে, যার ফলে একজন নারীও সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই নিজেকে গড়ে তুলেছে,সে তার মেয়ে, ছেলের বউ অন্য নারী সবাইকে সেভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। তাদের ধারণা মেয়েদের কোন ইচ্ছা থাকতে নেই,মত প্রকাশের কোন অধিকার নেই। পুরুষ যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে। এই ধারণা থেকে নারীরা বের হয়ে আসবো। ধীরেধীরে একটি প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলবো যেখানে নারী থাকবে নির্ভীক, শংকামুক্ত।
তবেই দিবসটি স্বার্থকতা পাবে।
১৯৯৩ থেকে ২০২০ অনেক দীর্ঘ সময়। আজো সারা বিশ্বে নারী বিদ্বেষী বর্বরতা দিনদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।তাই এই কাগুজে বিধান নয়, মানবিকতার দায় নিয়ে এর প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে।

★লিখাটিতে বিভিন্ন সূত্র থেকে কিছু তথ্য সংযোজিত হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here