দেশপ্রেম ও একজন সরোয়ার হোসেন
হাসানুজ্জামান
রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা নিয়ে আমরা কতটুকু সচেতন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে ! বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রীয় গৃষ্ঠপোষকতায় লেখাপড়া শিখেছি তাদের নিয়েই আমার এই লেখা। রাষ্ট্রের অর্থ দিয়ে পড়াশোনা করে রাষ্ট্রের প্রতি অবহেলা করা নিশ্চয় একজন ভাল মানুষের পরিচয় বহন করে না। রাষ্ট্রের অর্থ কোথা থেকে আসে সেটাও পরিষ্কার জানার দরকার রয়েছে। এ দেশের সাধারণ জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়েইতো রাষ্ট্র চলে। রাষ্ট্রের সকল খরচাদি চলে জনগণের অর্থদিয়ে। ফলে রাষ্ট্র এবং তার জনগণ একটি পারস্পরিক বিষয়।এ দুটি বিষয়ের মাঝে থাকে সরকার। সরকার জনগনের দেখভাল করে থাকে। আবার প্রকারন্তরে সরকার নির্বাচিত করে জনগণ।
একটি জাতীর উন্নয়নের পিছনে প্রথমে দরকার একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। ফলে পরিবার এবং সরকারের প্রচেষ্ঠায় শিশু প্রথম শিক্ষার পাঠ নেয় তার এলাকার প্রাইমারী স্কুলে। ধীরে ধীরে সেই শিশু বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা সমাপনির মধ্যদিয়ে বড় হতে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এক জন ছাত্রের পড়াশোনার খরচের কতটুকু তার অভিভাবক দিতে পারে ? যতটুকু দেয় তা দিয়ে নিশ্চয় তার ব্যক্তিগত কিছু খরচ মেটানো হয়তো সম্ভব হয় কিন্তু তার পরিপূর্ণ খরচ মেটানো কখনো যায় না। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো থেকে শুরু করে শিক্ষকদের বেতনাদির পুরো অংশই সরকারকে বহন করতে হয়। অবশ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি একটু আলাদা। কেননা সেখানকার সমুদয় খরচ এমনকি উন্নয়ন খরচও ছাত্রকে বহন করতে হয়। ছাত্রকে প্রতিমাসে গুণতে হয় হাজার হাজার টাকা। সেই খরচের অর্থ এ দেশের সব অভিভাবকের পক্ষে মেটানো সম্ভব হয় না। অপরদিকে সরকার পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পিছনে যে অর্থ খরচ হয় তা মেটানো হয় সরকারের কোষাগার থেকে। প্রকারন্তরে এ অর্থের যোগান দেয় জনগণ অর্থ্যাৎ জনগণের ট্যাক্সের অর্থ দিয়েই চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে একজন ছাত্রের শিক্ষার পিছনে সরকারী অর্থ অর্থ্যাৎ জনগণের একটি বিশাল পরিমান অর্থ ব্যয় হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ছাত্র জনগণের অর্থে পড়াশোনা করে জনগণের প্রতি কতটুকু দায়বদ্ধ থাকে তা নিয়েই আজকের আলোচনা। এই প্রশ্নটি শুধু যে আমাদের দেশের জন্যই প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়। এটি তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় একটি প্রশ্ন ? আমাদের দেশের ছাত্রদের দিকে তাকালে দেখা যায় পড়াশোনা শেষে তারা আয় রোজগারের দিকে নিজেকে সঁপে দেয়। এটি একটি স্বাভাবিক ও চলমান প্রক্রিয়া। নিজে রোজগারের মধ্যদিয়ে নিজের পরিবারের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং দেশের জনগণের প্রতি তাদের করণীয় কি সেদিকে আর নজর থাকে না। একটু খোলাসা করে বললে এভাবে বলা যায় তারা একেক জন হয়ে ওঠে আত্ম¦কেন্দ্রিক মানুষ। এই অবস্থা আমাদের দেশে অনেক আগে থেকে চলে আসছে। এই অবস্থার কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি দিন দিন আরো ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে।
অথচ আমাদের পিছনের দিকে তাকালে দেখা যায় আমাদের ইতিহাস অনেক গৌরবের। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে আমাদের শিক্ষিত যুবকরা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ ভাই – বোনদের প্রাণ গিয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের জন্য। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ সব ইতিহাস আমাদের ভুলে যাওয়া সহজ নয়। এ সব ইতিহাসই আমদের নতুন প্রজন্মকে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ ও সাহস যোগায়। জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়। দিন দিন দেশে স্বার্থপর মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কমছে নিঃস্বার্থ পরোপকারী মানুষের সংখ্যা।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেল ২৭ নভেম্বর মারা গেল দেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ি প্রকৌশলী সরোয়ার হোসেন। তার গ্রামের বাড়ী কুষ্ঠিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর গ্রামে। মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। বাবা ছিলেন একজন গোলাপনগর বাজারের ক্ষুদে ব্যবসায়ি। মা লেখাপড়া বলতে কিছুই জানতেন না। এ রকম একটি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে সরোয়ার হোসেন প্রতিনিয়ত দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে পড়াশোনার মধ্যদিয়ে হয়ে ওঠেন প্রকৌশলী। চাকুরির জন্য অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন কিন্তু সোনার হরিণ চাকুরি তার হয়নি। অবশেষে নিজের ছোট ভাইয়ের মালিকানাধীন গার্মেন্টসে অল্প বেতনে চাকুরি নেন তিনি। গার্মেন্টস ব্যবসা সম্পর্কে তার একটি অভিজ্ঞতা হয়ে যায় এই সময়ে। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খোলেন ঢাকায়। মেধাবী,সৎ ও সাহসী এই মানুষটির আর পিছনে তাকাতে হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যেই তার ব্যবসায় সফলতা আসে। তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যান।
আমাদের দেশের যুবকরা লেখাপড়া শিখে বড় বড় চাকুরি করে অহংকারি হয়ে যায়। আবার ব্যবসা বাণিজ্যে সাফল্য আসলে তিনি আর তার অতীতের দিকে ফিরেও তাকান না। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন এই প্রকৌশলী সরোয়ার হোসেন। তিনি একদিকে ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন অপরদিকে সেই অর্থের একটি অংশ নিজ এলাকার জনগণের জন্য খরচও করেছেন। তবে এই খরচ করার ভিতরে একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে তার অগ্রণী ভ’মিকা ছিল। তিনি নিজ এলাকার মোকারিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের গভর্ণিং বডির সভাপতির দায়িত ¡পালনকালে তার নেতৃত্বে নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে নানান কর্মকান্ডের পিছনে তিনি অকাতরে অর্থ খরচ করেছেন। তার উৎসাহে কর্তৃপক্ষ স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেই সব অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে মেয়েরা নিজেদের সচেতন ও স্বাবলম্বি হয়ে গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে আসছে। বছরে একবার স্কুলে তার সার্বিক পরিচালনায় চিকিৎসা ক্যাম্প বসে। এই ক্যাম্পে অভিজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে এলাকার মানুষদের চিকিৎসা দেয়া হয়। যাদের অবস্থা বেশি গুরুতর তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সব রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ তিনি নিজে বহন করতেন।
এলাকায় তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিযোগিতামূলক খেলাধূলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই সব খেলাধূলার মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ফুটবল খেলা। তিনি ছোট বেলা থেকে ফুটবল খেলার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। ফলে তার সহযোগিতায় এলাকায় একটি ফুটবল টিম তৈরী হয়। এই ফুটবল টিমটি শুধু এলাকাতেই নয় এলাকার বাইরেও খেলে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল খেলাধূলার মধ্যদিয়ে এলাকার ছেলেরা যেন নিজেদের সৎ ও সুন্দর ভাবে গড়ে তোলতে পারে। মাদক যেন তাদের কোন ভাবে স্পর্শ করতে না পারে। এলাকার বেকার ছেলেদের তিনি চাকুরির জন্য নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন। নিজের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে অনেকের চাকুরির ব্যবস্থা করে তাদের বেকারত্ব দূর করেছেন। এলাকার সুবিধাবজ্ঞিত ও দুঃস্থ মানুষের জন্য তিনি সব সময় আথির্ক সুবিধা দিতেন। বিশেষ অর্থের অভাবে যে সব মেয়েদের বিয়ে হতো না তাদের পাশে গিয়ে তিনি দাড়াতেন। এ ভাবেই তিনি নিজ এলাকায় একজন দানবীর সরোয়ার হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। সমসাময়িক চলমান রাজনীতির প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। তার মোহ ছিল না ক্ষমতার প্রতি। অনেকেই মনে করতেন তিনি হয়তো নির্বাচন করবেন। কিন্তু নির্বাচন করার মত সকল যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও তিনি রাজনীতির সেই জটিল পথে পা বাড়াননি। করোনাকালে এলাকার মানুষ যখন খেয়ে না খেয়ে দিন অতিবাহিত করছেন সেই সময়ে তিনি এলাকার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। অকাতরে দরিদ্র মানুষের মাঝে অর্থ ও খাদ্য বিতরণ করেছেন।
তিনি পড়াশোনা করেছেন স্থানীয় দামুকদিয়া হাই স্কুলে। ২০১১ সালে সেই স্কুলের পুরনো ও বর্তমান ছাত্রদের নিয়ে একটি পূণর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যার মাধ্যমে এলাকায় পুরাতন ও নতুন ছাত্রদের মাঝে একটি সেতু বন্ধন তৈরী হয়। এই সকল কাজে স্থানীয়ভাবে তাকে যারা সহযোগিতা করতেন তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ছিল রানা জামান, এ্যাড.তানজিলুর রহমান এনাম,রবিউল আলম মুন্নু, হাসানুজ্জামান,বেলাল হোসেন, ডা. সাইফুদ্দৌলা, জহুরুল হাসনাত হাসু,সামসুল আলম সান্টু প্রমূখ।
নভেম্বরের ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় সরোয়ার হোসেনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। যে মানুষটি এলাকার উন্নয়নে সর্বদা ভ’মিকা রেখেছেন তার মৃত্যু যেন মেনে নিতে পারেনি সাধারন মানুষ।
দেশের এখন প্রতিটি গ্রাম অজ্ঞলেই প্রভাবশালী শিক্ষিত ও অর্থশালী লোকজন দেখা যায়। কিন্তু মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এলাকার উন্নয়নে তেমন ভ’মিকা রাখে না। এই আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের জাতীয় উন্নয়নে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ঠি করেছে। ফলে দেশ, সমাজ পিছিয়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ লেখাপড়া শিখানোর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশ প্রেম শিক্ষা দেওয়্ া। বায়ান্ন ও একাত্তরের চেতনার আলোকে ছাত্রদের গড়ে তুলতে না পারলে আমরা সরোয়ারের মত সাদা মনের মানুষ সৃষ্ঠি করতে পারবো না। আর এমন মানুষ সৃষ্ঠি না হলে দেশ ,জাতি তাঁর লক্ষে পৌঁছতে পারবে বলে মনে হয় না।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক। ০১৭১১-১০৮৭৩৬