আদর্শ, চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধের আলোয় আলোকিত মোঃ নুরুল ইসলামকে নিয়ে অসীম কুমার পালের লেখা “বাবার আদর্শের প্রতিচ্ছবি দেখি সন্তানের মাঝে’’

510
মোঃ নুরুল ইসলামকে নিয়ে অসীম কুমার পালের লেখা "বাবার আদর্শের প্রতিচ্ছবি দেখি সন্তানের মাঝে’’

বাবার আদর্শের প্রতিচ্ছবি দেখি সন্তানের মাঝে
অসীম কুমার পাল

এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন আমি যুক্তরাজ্যের একটি ছোট অথচ অন্যতম সুন্দর শহর ব্রিস্টলে আছি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্কলারশিপে ইংরেজি ভাষা শিক্ষণ বিষয়ে পড়তে এসেছি এই শহরেই অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও সারাটা বছর শীতের আমেজে ডুবে থাকে এই দেশটি, তবে শীতকাল বলতে যা বুঝায়, তার সূচনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এমন শীতের সন্ধ্যায় লিখতে বসেছি আমার প্রিয় শিক্ষক, পরবর্তীতে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র সহকর্মী ও বিভাগীয় প্রধান রবিউল ইসলামের প্রয়াত বাবা মোঃ নুরুল ইসলামকে নিয়ে।

দিনটি ছিলো ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১, বৃহস্পতিবার, পড়ন্ত বিকেলবেলা। আমি আমার এক আত্মীয়ের এক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম রাজবাড়ীতে। সঙ্গে ছিলো সিনিয়র ভাই, কাকাসহ বন্ধুজন। বাসে এক ধরনের উষ্ণ আমেজ বিরাজ করছিলো। হঠাত ফোন এলো আমাদের ইংরেজি বিভাগের অতিথি শিক্ষক জাহিদের কাছ থেকে। একটু অবাক হলাম, এই সময়ে তো সে ফোন করে না! সেজন্য বাসের মধ্যে অব্যাহত কোলাহলের মাঝেও ফোন ধরলাম। ফোন ধরেই শুনতে পেলাম, রবি স্যারের বাবা আর নেই! খবরটি শুনে আমার মধ্যে যে আনন্দভাব ছিল, তা মুহূর্তেই উবে গেলো। আশেপাশে যে কিছুক্ষণ আগে মনে খুশি-আনন্দ-উতফুল্লতা দেখতে পাচ্ছিলাম, নিমিষেই সেগুলো যেন আমার চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলো।

মনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করলো। স্যারকে ফোন দেয়ার সাহস ও চিন্তা- দুটোই বাদ দিলাম। আসলে এমন পরিস্থিতিতে কী বলতে হয়, তা আমার জানা নেই। কিংবা, সেই সত্যের মুখোমুখি হয়ে কথাগুলো বলার মতো সাহসও আমার নেই। মনের অস্থিরতা কাটাতে পাশে থাকা এক সিনিয়র ভাইকে বললাম। তিনিও ব্যক্তিগতভাবে স্যারকে চেনেন। এরপরে তাকে আমি বললাম, “স্যার যেভাবে তাঁর বাবাকে ভালবাসেন, এখন স্যারের কী অবস্থা হবে? এই প্রশ্নটি আমাকে সারাটি রাস্তা ও পরবর্তী সময়গুলো ভাবিয়ে তুললো। এই ভাবনার পেছনের সত্যগুলো নিয়ে আমার এই লেখা।

স্যারের সাথে পরিচয় হয় ২০১০ সালে যখন তিনি সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে বদলি হয়ে এলেন। খুব অল্প সময়ের জন্য স্যারের সাথে পরিচয় হলেও স্যারকে মনে রেখেছিলাম তাঁর প্রথম দিনের একটা কথার জন্য। তখন আমরা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। স্যারের প্রথম ক্লাসে আমাদের সাথে পরিচয় পর্ব ও ক্যারিয়ার সংক্রান্ত আলাপ-পরামর্শ শেষে স্যার জানালেন, তিনি আমাদের Classics in Translation কোর্স পড়াবেন। তবে যেহেতু তিনি এই কোর্সের বিষয়ে বিশদ অধ্যয়ন করে আসেন নি, তিনি পরের ক্লাস থেকে আমাদের পড়ানো শুরু করবেন। আমি একটু অবাক হলাম। সাধারণত, মানুষ তার দুর্বলতা ঢাকতে নানাবিধ মিথ্যার আশ্রয় নেয়, সেখানে শিক্ষার্থীদের সামনে এভাবে সহজ স্বীকারোক্তি আমাকে আশ্চর্যান্বিত করলো। আমার কৌতুহলী মন কিন্তু সেই আশ্চর্যের বিষয়কে প্রশ্ন আকারে মনের গভীরে রেখে দিলো।

এই ঘটনার পেছনের সত্যের সন্ধান পেলাম যখন আমি বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে যোগদান করার এক বছর পর ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগে বদলি হয়ে এলাম। বিভাগে যোগদানের পরেই রবি স্যারের সাথে আন্তরিকতা যেন ভাই-ভাইয়ের মতো সম্পর্কে রূপান্তরিত হলো। আমরা ক্লাস নিই, পরীক্ষা নিই আবার আমার যখন রান্না করতে মন চায়, স্যারকে বলতেই অনুমোদন পেয়ে যাই আর তখনি বিভাগে পিকনিকের আয়োজন করে ফেলি। এছাড়া, উচ্চতর অধ্যয়ন বিষয়ে স্যারের নানাবিধ পরামর্শ তো ছিলই। আর এর মাঝে ৭ বছর আগে উত্তর না জানা প্রশ্নের উত্তরও যেন খুব সহজে এসে আমার কাছে ধরা দিলো।

স্যারের প্রতিটি ভাবনা, আদর্শ ও উদ্দেশ্য যেন সৌরজগতের গ্রহগুলোর মত তাঁর বাবাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। আমি স্যারের বাবাকে সাক্ষাতে দেখি নি কিন্তু স্যারের কথা থেকে উপলব্ধি করি, স্যারের মনোজগৎ যেন তাঁর বাবার চিন্তাধারা, আদর্শের প্রতিচ্ছবি। স্যারের মুখ থেকে শুনতাম তাঁর বাবার আদর্শের কথা; বুঝতাম, কতটা সংগ্রামমুখর জীবন তিনি বেছে নিয়েছেন কেবল সত্য ও সততাকে আপন করে পেতে। পার্থিব ধনসম্পত্তি নয়, তিনি আধ্যাত্মিক অর্জনকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের আদর্শ হিসেবে। আর সেই ভাবনার বীজ বপন করেছিলেন তাঁর সন্তানদের মাঝে, যার অঙ্কুরোদগম খুব কাছ থেকে দেখতে পাই রবি স্যারের মাঝে। স্যারের মাঝে ধারণ করা সেই আদর্শ, চিন্তাধারা তিনি ছড়িয়ে দিতেন তাঁর আশপাশের মানুষের মাঝে। ক্লাসরুমে ও ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের তিনি বাবা-মায়ের প্রতি ভালবাসার প্রগাঢ়তা ও সন্তান হিসেবে দায়বদ্ধতার চিন্তার স্রোত দিয়ে আলোকিত করার প্রচেষ্টা চালাতেনঃ কখনো মুখ নিঃসৃত কথামালা দিয়ে, কখনো লেখনির মাধ্যমে। আর এই উদ্দেশ্যে স্যার জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে একটা গ্রুপ খুলে ফেলেন যার নাম তিনি দিয়েছেনঃ Values Education। স্যার যে মূল্যবোধ, আদর্শ ও মানবিক চিন্তাধারা তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন, তাঁর প্রতিফলন যেন এই গ্রুপে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা, উক্তির মাধ্যমে স্যার প্রতিনিয়ত তুলে ধরছেন। যেহেতু এখনকার শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি স্বতঃস্ফুর্ত ও সাবলীল, স্যারের তৈরি করা গ্রুপ তাই স্যারের সেই মূল্যবোধ, আদর্শ ও মানবিক চিন্তাধারাকে আরো বেগবানভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

আপাতত, এখন আমাদের দুজনের কেউই কলেজে নেই । স্যার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস-এ পিএইচডি করছেন আর আমি ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি বলে কলেজ থেকে বিমুক্ত আছি। তো যখন আমরা দুজনেই ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে চাকরি করতাম, প্রতিদিন কলেজে থাকাবস্থায় স্যারের ফোনে তাঁর বাবার ফোন থেকে কল আসতো। আমি দেখতাম, স্যার তাঁর বাবার কাছে সারাদিনে যা যা করেছেন, তার অকপট বর্ণনা দিচ্ছেন। এই বর্ণনার মাঝে কোন বাহুল্যতা নেই, কোন সংকোচ নেই। ঠিক যেন স্যার এক বালক মন নিয়ে তাঁর বাবার সাথে কথা বলছেন। তাঁর বাবা তাঁকে যে নির্দেশ দিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, তা তিনি বিনম্রভাবে মেনে নিচ্ছেন। আমি যেন আমার পরিণত, প্রজ্ঞাবান রবি স্যারকে দেখছি না; দেখছি, একজন বালক কিংবা সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণ যে তাঁর বাবার দেখানো চিন্তাভাবনা, আদর্শ মেনে চলার প্রাণপণে চেষ্টা করছে। এখানে কোন ছলনা নেই, মিথ্যে আশ্বাস নেই। কেবল আছে, বাবাকে ভালবাসার অপূর্ব প্রতিচ্ছবি, দুনির্বার প্রচেষ্টা। আর এখান থেকেই আমি পেয়ে গেলাম সেই সাত বছর আগে মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নের উত্তর। বুঝলাম, সেই আমাদের ক্লাসে স্যারের সহজসরল স্বীকারোক্তি, সেই অকপটতা, সেই সত্যের বীজ রোপিত হয়েছিল তাঁর বাবার মাধ্যমে। সত্যকে গোপন করার মাঝে গৌরবের কিছু নেই, বরং সত্যকে আঁকড়ে ধরে, সত্যকে ধারণ করে বাঁচার মধ্যে আছে আত্মিক সুখ, পরম প্রাপ্তি। আর স্যার তাঁর বাবার দেখানো সেই কঠিন কন্টক পথকে বেছে নিয়েছেন আপন করে। ঠিক যেমনটি ইংরেজি সাহিত্যের প্রথিতযশা কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন তাঁর “The Road Not Taken” কবিতার মাধ্যমেঃ
Two roads diverged in a wood, and I—
I took the one less traveled by,
And that has made all the difference.

আমরা সকলেই সেই আপ্তবাক্য ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠায়ঃ
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
কিন্তু আমি যতটুকু রবি স্যারকে কাছ থেকে দেখেছি, বুঝেছি, তাঁর পিতা তাঁর মাঝে সদাজাগ্রত। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ও জগতের নিয়মে তিনি এই পার্থিব পৃথিবী থেকে অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। তাঁর জাগতিক অনুপস্থিতি স্যারকে একাকী করেছে, ব্যথিত করেছে সত্য কিন্তু তিনি যে তাঁর আদর্শ, চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধের আলোয় আলোকিত করেছেন তাঁর সন্তানদেরকে, সেটি প্রবাহিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সেই আদর্শ, চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধ সংকীর্ণতা ও অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে পরাজিত করে দেশ, সমাজ ও পৃথিবীকে রূপান্তর করবে এক মানবিকতার আশ্রয়স্থল হিসেবে। সেই দিনের প্রত্যাশায় রবি স্যারের শ্রদ্ধেয় বাবার বিদেহী আত্মার চিরশান্তি প্রার্থনা করছি।

অসীম কুমার পাল, প্রভাষক, ইংরেজি, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার, ৩৪তম বিসিএস এবং বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্কলারশিপে (বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্প) যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here