পিয়াল আমার ভাই
বোন নাসরিন জাহান মাধুরী
২৪ এপ্রিল ২০১৯ আমাদের পরিচিত ভুবনটা আবারো অপরিচিত হয়ে ওঠলো। মাত্র এক বছর হলো চপল ভাইকে হারিয়েছি সেটা সামলে দাঁড়াতে পারিনি তখনো, এর মাঝে পিয়ালের হঠাৎ করে দৃশ্যান্তর আমাদের পরিবারটাকে চুরমার করে দিয়েছে। আমার ছোট ভাই পিয়াল।
পিয়াল চাইতো আমি আমার আত্মপরিচয় নিয়ে চলি। আমার আটপৌরে জীবনটা ওর পছন্দ ছিলো না।আমার সাথে ছোট বেলায় পিয়ালের বন্ডিংটাই এমন ছিলো। বন্ধুত্ব আবার মারামারি দুইটাই চলতো। স্কুল জীবনেই কবিতা লিখতো। লিখে আমাকে প্রথমে দেখাতো। আমি নিজে কখনো লিখবো তখন এমন ভাবনাও ছিলো না। ভাবতাম লিখাটা শুধু পিয়ালের জন্য।
বন্ধুদের কাছ থেকে রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট এনে আমরা আবার কপি করে রাখতাম। কত গান আমরা কালেক্ট করেছি, আব্বাও শুনতেন আমাদের সাথে।
আমরা দুই বোন চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম আর পিয়াল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ব বিদ্যালয়ে। আমরা সেশন জ্যামে আটকে ছিলাম, পিয়ালের কোন সেশন জ্যাম ছিলো না। পড়া শেষ হতেই ঢুকে গেলো এনজিওতে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও ঘুরে বেড়িয়েছে পথ নাটক, গান দিয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে, এই স্বল্প জীবনে থেমে থাকে নি আমার ভাই।
শিকড়ে পৌঁছে গেছে জন জীবনের, তুলে এনেছে তাদের জীবন যাপন, তাদের সংস্কৃতি আর বিনোদনের স্থানীয় উপাদান গুলো।
মাঝে মাঝে ভোর বেলায় আমাদের দুই বোনকে চমকে দিতে পৌঁছে যেতো বিশ্ববিদ্যালয় হলে। রাতভর জার্ণি করে আমাদের কাছে যেতো। হলের দাদু যখন ডাকতেন নীচ থেকে রিপন জোনাকি তোমাদের গেস্ট এসেছে, আমরা বুঝে যেতাম পিয়াল এসেছে। ছুট লাগাতাম দুইবোন।
কি আনন্দ! তিন ভাইবোন মিলে ক্যাম্পাসে ভোরের হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতাম, কোন ঝুপড়িতে সকালের নাস্তা সেরে আবারো হাঁটতাম।পিয়াল তার দরাজ গলায় একটার পর একটা গান গেয়ে যেতো আর আমরা হাঁটতাম আর শুনতাম — এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুল গুলি ঝরে, আরো কত গান ।
ওর চোখ দুটি এমন জ্যোতিময় ছিলো, ও মুখ দেখেই পড়ে ফেলতে পারতো আমাদের। বলতো কিছু চিন্তা করো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আব্বাকে হারিয়ে আমরা তখন খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।
আমার মাস্টার্সে প্রজেক্ট পেপার ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মলাস্ক ( শামুক) এর ওপর। দুই ভাইবোন ভোরবেলায় চলে যেতাম কুড়ুলিয়ার খালের পাশের ধান ক্ষেতে, তিতাস নদীর তীরে, পিয়াল আমাকে সহযোগিতা করতো সংগ্রহে।
বাংলা একাডেমিতে রিসার্চ ফেলো হিসেবে দুই বছর ছিল। বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ওর গবেষণা গ্রন্থ “নৌকা বাইচ”। পিয়ালের কবিতার বই দামোদর, জলযাত্রা, নদীশ্রুতি সব শেষ বইটি “স্মৃতির ভ্রমণ” ওর টাইমলাইন থেকে সংগ্রহ করে ভাইবোনেরা চেষ্টা করে প্রকাশ করেছি।
আমাদের কত গল্প শেষ হবার নয়।
পিয়াল স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলো পিএইচডি করতে, জোনাকি মামিয়া ওপিতে জয়েন করলো। তখন চিঠি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো।পিয়াল ইমেইল করতো জোনাকিকে, সবার খবর নিতো, ছবি পাঠাতো, গল্প করতো।
আমি চাকরিতে জয়েন করেছি জেনে কি খুশি পিয়াল।
আমার ছেলেমেয়েদের নাম ওরই দেয়া– রিনিকি আর আভাস। রিনিকি নামেই পিয়াল ডেকেছে।
আমার লিখায় প্রেরণা দিয়ে গেছে সব সময়। আমার বইটি প্রকাশের আগের দিন সিলেটে এলো, শুভ কামনা জানিয়ে গেলো। এটাই হয়তো রক্তের টান, ভালোবাসার টান।
গত বছরে ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় ফোন করলো আমি যাচ্ছি আজ রাতের ফ্লাইটে, দোয়া করো।আরো কিছু কথা হলো, নিজের কেয়ার নেয়ার জন্য বললো। ফেমিলি গ্রুপে ছবি দিয়ে যাচ্ছিলো, কথা বলে যাচ্ছিলো একটু পরপর।
সকালে ক্লাস থেকে এসে অনলাইন হতেই দেখলাম ওর শেষ পোস্ট, হিথ্রো বিমানবন্দরের ছবি। আমি বেস্ট ওইশ কমেন্ট করে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম অন্য কাজে। ভেবেছি প্রায়ই বাইরে যায়, প্রেজেন্টেশন থাকে বিশ্ববিদ্যালয় সেমিনারে, এবারেও তাই।
বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে আটটায়, ইংল্যান্ডের স্থানীয় সময় রাত ২ঃ৩০ এ কথা বলে , মেসেঞ্জারে ইংল্যান্ডের ফোন নং দিয়ে আম্মার সাথে কথা বলে ঘুমাতে গেলো বার্মিংহামের কোন এক হোটেল রুমে। ঘুম থেকে আর জাগলো না আমার ভাইটা।
সবাইকে যেতে হবে জানি, সদা প্রস্তুত তার জন্য কিন্তু ছোট ভাই চলে গেলে বুকের ভেতর যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয় তা থেকে নিরন্তর ক্ষরণ চলে সেটা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। আমাদের ভাইবোনের সম্পর্কটাই এমন ছিলো।
#নাসরিন জাহান মাধুরী
২৪.০৪.২০