ভারত থেকে সমাজ বিশ্লেষক-কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র এর পুজোর গান ও বর্তমান নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা “কোথায় গেল পুজোর গান! বিশ্বায়ন কি রুচি পাল্টে দিলো ”

483
ভারত থেকে সমাজ বিশ্লেষক- কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র এর পুজোর গান ও বর্তমান নিয়ে বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “কোথায় গেল পুজোর গান! বিশ্বায়ন কি রুচি পাল্টে দিলো ”

কোথায় গেল পুজোর গান! বিশ্বায়ন কি রুচি পাল্টে দিলো…

                                 কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র

পুজো মানেইতো বাঁধনছাড়া আনন্দ,বন্ধুদের জমায়েত, দেদার আড্ডা।গান ছাড়া, হয় নাকি!
কিন্তু, সেইগান!!! কোথায়?
পুজোরগান প্রকাশ করা নিয়ে, সারা বছর ধরে চলতো প্রস্তুতি। শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, রেকর্ড কোম্পানির সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। কেমন করে একটা গান হিট যায়,এই নিয়ে সারাবছর ধরে কাজ হতো। এখন যে হয় না, তা একেবারেই বলছি না.. তবে সেই মাদকতা, রোমান্টিসিজম, আবেগ.. কোথায় হারিয়ে গেল!!
বেশ মনে আছে, আমার খুব ছোটবেলায়, বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। এখনো আছে, স্মৃতি বিজড়িত হয়ে। পুজোর গানের রেকর্ড আসত, মায়ের সঙ্গে গিয়ে কিনে আনতাম। তারপরে এলো, ক্যাসেটের যুগ। এই ক্যাসেট যুগ অনেক দিন ছিল। তারপরে এলো, সিডি। বছরের অন্য সময় গান প্রকাশ হলেও, পুজোর গানের আলাদা আগ্রহ ছিল তখন। পুজোর সময় তো পড়াশোনা করতে নেই, ছুটি, এমনই ধারণা ছিল। তাই সারাদিন গান শোনা হতো। একই গান যে, কতবার বাজতো…..
সেই সঙ্গে চলতো, মা-বাবাদের সময়ের পুজোর গান আর আমাদের সময়ের পুজোর গানের কথা- সুর – গায়কীর আলোচনা।
আকাশবাণীর বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-র জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে, বাঙালির চিরন্তনী আবেগ কতখানি… দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে…
রামপ্রসাদের সময় থেকেই আগমনী গানের শুরু। পুজোকেন্দ্রিক গানের প্রথম বীজ লুকিয়ে ছিল সেই আগমনী গানেই। তারপরেও অনেক গান হয়েছে। ইন্দুবালা, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, দিলীপকুমার রায় ও কমলা ঝরিয়াদের মতো বিখ্যাত শিল্পীরাও পরিচিত হয়েছিলেন, পুজোর গান দিয়েই।১৯৩১ এ ধীরেন্দ্রনাথ দাসের, আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের, এলো গিরি-নন্দিনী, ল’য়ে সুমঙ্গল ধ্বনি। আজও বিখ্যাত, ওই গান কখনো পুরানো হবে না।
ছয়-সাত দশকের অন্যতম আকর্ষণই ছিল, পুজোর গান। এইচ এম ভি থেকে পুজোর গান প্রকাশ হবে, কী উত্তেজনা,কী আগ্রহ ছিল তখন। পুজোয় যেমন নতুন গান রেকর্ড হত তেমনি পাড়ায় পাড়ায় জলসাও বসত। সেখানে গাইতেন বিখ্যাত শিল্পীরা।
অনুরোধের আসরও নেই, প্যান্ডেলে পুজোর গানও এখন স্মৃতি। কানে ইয়ারপ্লাগ গোঁজা আধুনিক প্রজন্মের কাছে শুধুই ইতিহাস। তবে কালীপুজোর পরে অবশ্যই পাড়ায় পাড়ায়, বিকট আওয়াজে অর্কেস্ট্রা সহযোগে অনুষ্ঠান হয়।
সেই সময়ের শিল্পীরা, পরিচিত ছিলেন তাঁদের গান, কণ্ঠস্বর আর ছবিতে। এখন ঠিক উল্টো, গান ভুলে গেলেও শিল্পীকে মনে থাকে, টিভি এবং সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এটা খারাপ বলছি না, সেই সময়ে এই মাধ্যম ছিল না, তবুও আন্তরিকতা ছিল তাঁদের জন্যে।
প্রায় একশো বছর আগে শুরু হওয়া পুজোর গানের যুগটা হারিয়ে গেছে। সেই সব কথা, সুর, কণ্ঠ… সত্যিই অমূল্য। নতুন পুরনো মিলিয়ে কিছু গান পুজোয় প্রকাশিত হয়, কিন্তু সেই উন্মাদনা কোথায়? স্বীকার করতেই হবে, স্বাদ, ভাবধারা, চিন্তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সুরে, কথায় নতুন ধারা এলেও, কম্পিটিশনের যুগে প্রয়োজনের থেকে আয়োজন বেশি হয়ে পড়াতে, কথা সুর কোনটাই কালজয়ী হয়ে উঠতে পারছে না।তার মানে যে ভালো গান তৈরী হচ্ছে না, সেটা নয়। গানের অবস্থান ভালো জায়গাতেই আছে,কিন্তু স্বর্ণযুগের মতো দীর্ঘস্থায়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী।

স্বর্ণযুগের সেই সব কালজয়ী পুজোরগান, যা আজও প্রাণে মনে রয়েগেছে…. গাঁয়ের বধূ(১৯৪৯), অবাক পৃথিবী (১৯৫০), রানার(১৯৫১), পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি(১৯৫৮), আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা(১৯৬৯), (১৯৬০) অলির কথা শুনে বকুল হাসে, আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি। ওগো মোর গীতিময়(১৯৫০), মধুমালতী ডাকে আয়(১৯৫৭), মান্না দে-র আমি নিরালায় বসে(১৯৫৯), গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে (১৯৭৮), আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি (১৯৫৮), প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে(১৯৫৭), না যেয়ো না( ১৯৫৯), ওই আঁকা-বাঁকা যে পথ যায় সুদূরে(১৯৬২), গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে(১৯৬৯), শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি(১৯৭০),একদিন পাখি উড়ে যাবে(১৯৬৯), নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে(১৯৭৩), মনে পড়ে রুবি রায়(১৯৬৯),যেতে দাও আমায় ডেকো না(১৯৬৯),এই মোম জোছনায়(১৯৭৮), তোমায় কেন লাগছে এত চেনা(১৯৭৯)। আরও রয়েছে…
পুজোর এইসব গানই, বাংলাগানের এক-একটা মাইলস্টোন। ১৯৬৬ এ পান্নালাল ভট্টাচার্যের ভক্তিমূলক গান।এঁরা ছাড়াও,আরও অগণিত শিল্পীরা যে অবদান রেখে গেছেন, বাঙালির ঐতিহ্যস্মৃতিতে তা চির অমলিন হয়ে রয়ে যাবে।
১৯৯২ এ বাংলা আধুনিক গানের লিরিক ও সুরের স্ট্রাকচার আমূল বদলে গেল, কবীর সুমনের গানে। গানে গানে উঠে এলো সাধারণ মানুষের কথা। ১৯৯৩ এ কবির সুমন ১৯৯৩ এ নচিকেতা,১৯৯৪এ অঞ্জন দত্ত। বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়ে কালজয়ী হয়ে গেল সেবছরের পুজোর সেই গান— ২৪৪১১৩৯ বেলা বোস।নয়ের দশকের শেষে বেসিক গানের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে অন্য হাওয়া নিয়ে এলেন লোপামুদ্রা মিত্র। অনেক বিখ্যাত আধুনিক কবিতা লোপামুদ্রার কন্ঠে গান হয়ে গেল। এই ধরনের গানে তিনিই হয়ে উঠলেন ট্রেন্ডসেটার। ধাধিনা নাতিনা(২০০১), যাও পাখি(২০০৩)। এরপরেই দেখা গেল ব্যান্ড-সংস্কৃতির প্রসার। উঠে এল ভূমি, চন্দ্রবিন্দু, ক্যাকটাস প্রভৃতি জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড। প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে বাজতে থাকল বারান্দায় রোদ্দুর(২০০০), হলুদ পাখি(২০০২)। এলেন রূপঙ্কর বাগচী, রাঘব চট্টোপাধ্যায়, শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। বাংলা আধুনিক গানে এল অন্য সকাল।
বেশ চলছিল, বেঁচেছিল পুজোর গান। বিশ্বায়ন নিয়ে এলো ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতা। বন্ধ হয়ে গেল বেসিক অ্যালবামের রেকর্ডিং। ক্যাসেট বা সিডির ধরনটা আর সেভাবে না থাকায়, উঠে গেল প্রখ্যাত কয়েকটি মিউজ়িক স্টোরও।
বিশ্বায়ন বিনোদনের রুচি বদলে দিল, এলো থিম সং। একালের শিল্পীদের কাছে এ একধরনের পুজোরই গান। সেই ঐতিহ্যের কথা ভেবে এখনও অনেক শিল্পীই কিছু না কিছু রেকর্ড করে থাকেন। যদিও তার সংখ্যা খুবকম, সেইসঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে তার জৌলুসও। সময়ের অদ্ভুত আবর্তনে আমরা যেন পিছিয়ে গিয়েছি সেই গানের যুগের থেকে। পুজোর গানকে কেন্দ্র করে গীতিমুগ্ধ বাঙালির যে আবেগ ছিল, এখন আর সেটা কোথায়…! মানুষ এখন অনেক বেশি ব্যস্ত, তার প্রাত্যহিক সোশ্যাল সাইটে। গান এখন পথচলতি ইয়ারফোনে। কোনওরকমে ধুঁকছে পুজোর গান। আমরা আশাবাদী, কোনও একদিন হয়তো এই ডিজ়িটাল প্ল্যাটফর্মের হাত ধরেই, নতুন কোনও ফর্মে ফিরে আসবে বাঙালির পুজোর গানের সেই আবেগ। শিল্পীরা রয়েছেন, আমরাও রইলাম অপেক্ষায়…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here