পিতার তান গায় সন্তান
তারিফ হোসেন
মহাজগতে পালকসত্তা পালাক্রমে প্রতিপালন কার্য সম্পাদন করেন। তার নেই বিরতি, প্রতি মুহূর্তে ঘটে তার তানের বিস্তার। আপনাকে বিলিয়ে দেন সন্তানের মধ্যে।আত্মজ হয় হৃষ্ট-পুষ্ট-তুষ্ট। জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই দীক্ষা দেন জীবন পরিক্রমার ভৈরবী সুরের সাধন।মীড়, মূর্ছনা, ঠাটের ঢলন ঠিক রেখে সন্তান গেয়ে যায় গুরুপিতার শেখানো জীবন সংগীত।যুগল পরিবেশনায় একের তান মিশে যায় অন্যের তানে। সন্তান-পিতায় থাকে না ভেদ; আদি-অন্ত একাকার।
পিতাকে ফুটিয়ে তোলে সন্তান, সন্তানকে প্রস্ফুটিত করে পিতা। একে অপরের আয়নায় মুখ দেখে। সে এক আদর্শ আরশিনগর। এমন একটি আয়নাপুত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল বছর সাতেক আগে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে; বন্ধুপ্রতিম অগ্রজ হাসান আহমেদ চিশতির সঙ্গে চা-স্টলে বসে রসালাপ চলছে। চল্লিশের কোঠায় পা দেওয়া একজন রবাহূত স্টলে প্রবেশ করলেন। মুখে প্রমিত হাসি, চোখে দীপ্তি, কণ্ঠে আনন্দের স্ফুটন। হাসান ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন; রবিউল ইসলাম, ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। রবির করের সাথে ঘটে গেল প্রথম করমর্দন; আমাদের সাত্ত্বিক আলোচনায় উনি একীভূত হতে শুরু করলেন। সদ্য আগত আয়নাতলে অখন্ড চেতনার প্রতিফলন দেখলাম। ছান্দিক আলোচনার ভুবনে ঘটল বান্ধবসুরের অনুপ্রবেশ। ঘণ্টাব্যাপী চলেছিল সেই স্মৃতিখোদিত সুরালাপ।
এই সূর্যসন্তানের পূর্বসূরীকে চিনেছি আমি উত্তরের দর্পণে; প্রত্যক্ষ করিনি, অনুভব করেছি। আয়নাপুত্র ছিল আমার পরোক্ষ মাধ্যম। পিতৃলোকের আলোক রবিউলের চোখে জ্বলজ্বল করে,তার মুখ থেকে ধ্বনিত হয় পিতার আবৃত্তি। বৃত্ত নিয়ে যায় কেন্দ্রে। পরিধি রবিউল, কেন্দ্র নুরুল ইসলাম। পরিধি থেকে খবর পাই কেন্দ্রের। পরিধির মন মানুষকে আপন করে নেয়, দিলখোলা হাসিতে বরণ করে; অহেতুক আনন্দে মেতে ওঠে,পরমকে অনুসন্ধান করে; জগৎ-সংসারে করে সাত্ত্বিক চলাফেরা।
বুঝতে পারি নুরকেন্দ্রই রবির ভরবিন্দু। পিতৃচেতনার উৎসকূপে জমে থাকা আবে জমজমের অমৃত ধারায় হামেশা অভিষিক্ত হয় রবি পরিবার। পারদর্শী রবি মাঝির নৌকায় চড়ে নুরপুরের খবর পাই। সেই ভূগোলে দেখি ক্ষমা, সৌন্দর্য, নমনীয়তা ও নান্দনিকতার সংস্কৃতি। নূরীসত্তা ধারণকারী নুরুল ইসলামদের মৃত্যু নেই। আলোকনিধি হিসাবে তারা রবিউল গোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব দান করে। পরম্পরার পর্যায় সারণিতে সত্যবলধারী এই সকল পুরুষের বহুবলরূপে রবিউলরা আসতে থাকবে জগৎ পরিক্রমায়। শুঢিশূভ্র,সফেদ জগৎ বিনির্মাণে নুরুল-রবিউল যুগল-মানসে স্নাত হোক আজকের মন।
পিতা তার এষণায় পরমপিতার মূল অন্বেষণ করে। মগজে-মননে চলে নিত্য অভিযোজন প্রক্রিয়া; যোগরূঢ় পিতা যুক্ত হয় মূলের সঙ্গে। আবির্ভাব ঘটে মূল্যের। পিতার বুধমন্ডলীতে বসে মূল্যবোধের মেলা। সোনালি স্নেহপাত্র, রূপালি দয়ার কলস, রত্নখঢিত শ্রদ্ধাসামগ্রীর পসরায় জমে ওঠে চৈতন্যমেলা। মেলার বিজ্ঞাপন দিকেদিকে হয় প্রঢারিত। রবিউল পরিবার আমণÍ্রণ পায় নুরমেলায়। চৌকস রবিউল টপাটপ তুলে নেয় নির্বাচিত পণ্যসম্ভার। অনুজেরা অনুসরণ করে অগ্রজের পদাঙ্ক। নুরমেলার সুবাদে রবিউল-বলয়ে এখন অমূল্যধনের প্রাচুর্য।
সংসার-সরণির যে কোনো ব্যবসায়কে নুরতন্তু অধ্যবসায়ে পরিণত করে ফেলে। নুরায়তনে প্রত্যহ শোনা যায় ফাতিহা পাঠ। বরজোখের নুরদৃষ্টির অনিমেষ পর্যবেক্ষণ থাকে রবিউল ঢত্বরে। রবিচাতক পান করে নুরবারি; উদ্যান ভরে যায় উর্বর কিশলয়ে। রবিভক্তরা পায় সবুজের স্বাদ। রবিমৌসুমে এখন ভূত-ভবিষ্যৎ নেই, তাতে কেবল বর্তমানের নিত্যতা। ফাতিহার ঐশী শক্তি তাড়িয়েছে সময়ের প্রেতাত্মাকে। রবির দন্ডায়মাণ চেতনার মেরুদন্ডে খেলে যায় নুরের জ্যোতি।
ইব্রাহিমজাত আব্বাদের আয়ুবহনকারী নুরুল ইসলাম আবেহায়াতের তরী রেখে যায় রবিউল-ঘাটে। এই তরিকায় রবিস্বজনদের চলে খেয়া পারাপার। ঈশান কোণের মেঘ দেখে তারা বিচলিত হয় না। ওরা জানে মেঘের আড়ালে আছে নুরসূর্য। এমন অনেক বিপদ ,সম্পদ হয়ে যায় সৌরপিতার কল্যাণে। পিতার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হয় পুত্রের মহান আত্মায। আত্মা সংস্কার ও সংবর্ধনের কারখানায় রবিকামার দেয় নিত্য হাজিরা। পিতার পাকাল ধাতুতে গড়ে ওঠে সন্তানের আত্মিক অস্ত্র। নুরইস্পাতে তৈরি রবিতরবারিতে ঝিলিক মারে মহাচেতনার রশ্মি।
লেখক: তারিফ হোসেন, শব্দ গবেষক, কুষ্টিয়া। প্রথম গ্রন্থ- ধাতুসুধায় লালনপাঠ।
শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,বেদনায় ‘’নুরুল ইসলাম’’ স্মরণে মানব সভ্যতার সারথি -মো.নূরুল হক এর লেখা “বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব”
[…] […]