বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব
মো. নূরুল হক
আমার এই পরিনত বয়সের সময়টাতে, অনেক স্মৃতি আসে আবার চলে যায়, কোনটা বা অতীত কোনটা বা বর্তমান, যেগুলো একবারে ঢাকা পড়ে গেছে, সে গুলো অতল গহ্বরে বিলীন; কিছু কিছু মূল্যবান, যা না হলে জীবন দর্শন টাই অসমাপ্ত থেকে যায় এবং মূল্যহীন বলে মনে হয় , যে গুলো না হলে মন চলে না, দেহ চলে না। হ্যাঁ সত্যিই মাঝে মাঝে তন্ময় হয়ে ভাবি, এমনি ভাবনার মধ্যে যেমন বলা যায় কোন ভ্রমন কাহিনীর কথা যেখানে অনেক সুন্দর প্রকৃতির লীলা সৌন্দর্য, সে সব স্মৃতি থাকে আবার থাকেও না। কিন্তু আজ ভাবছি অন্য আঙ্গিকে অন্য বিষয়। গোটা জীবনকে যদি তন্ন-তন্ন করে মন্থন করি এবং দেখি, কোন বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ, হতে পারে একজন ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের দর্শন, কিছুক্ষণ হলেও তার সান্নিধ্য পাওয়া, যা হতে পারে নিজের জীবনকে আলোকিত করার একটা উপায়। এই জন্য বোধ হয় আদেশ করা হচ্ছে– You are commanded to be in the rank of righteous. একজন ভালো মানুষের সংস্পর্শে থাকো ।
মরমি কবি মৌলানা রুমিও তাই বলেন:-
“সোহ্বতে সালে তোরা , সালে কুনাদ-
সোহ্বতে তালে তোরা , তালে কুনাদ”
অর্থাৎ ভালোর সংস্পর্শে এলে ভাল, আর মন্দের সংস্পর্শে এলে মন্দ।
সে কথায় আসছি কে সেই, যাকে না ভাবলেই নয়, যার কথা না বলেলেই নয়, এমন একজন আদর্শবান মানুষের ‘Biography’না লিখলেই নয়। সেই শ্রদ্ধেয় ভাজন “নুরুল ইসলাম” আমাদের ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের শিক্ষক ‘ইংরেজী’ স্বনাম ধন্য শিক্ষক ‘রবিউল ইসলামের’ পিতা। যার সঙ্গে আমাদের কয়েজন নিয়মিত অবসরে তাত্তি¦ক বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, সেই পরিসরে, আমি রবিউল ইসলাম, হাসান আহমেদ চিশতী, আশিকুর রহমান (লুলু) এবং আরও কয়েকজন। আলোচনার আড্ডা ‘ইসহাক’ ভাইয়ের চায়ের দোকান রেলওয়ে মালগুদাম সংলগ্ন ঈশ্বরদী ।
একটু না বললেই নয় , এই ‘রবিউল ইসলামের’ সাথে আমার ‘হাসান আহমেদ’ এর সূত্র ধরেই পরিচয় সেখান থেকে একদিন দুইদিন করতে করতে, আজ প্রায় অনেকদিন হয়ে গেল। লালন এর একটা গানের কলি ধরে যদি বলি, তিন পাগলের হল মেলা নদে এসে। আমাদেরর আলোচনার জায়গায় অনেক গুলো পাগলই ছিল। লালনের তিন পাগলের দেখা না হলে কি হত জানি না, কিন্তু আমাদের সাক্ষাৎ না হলে, বেশ বলা যায়, অনেকটাই অস্থির বোধ করতাম।
তারপর আস্তে দিন যায়, সময় যায়, মাস ও বছরও এই ভাবেই ‘রবিউল’ এর সঙ্গে বসি আলোচনা হয় বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা হয়, আস্তে আস্তে হৃদ্যতা ও আন্তরীকতাও বাড়তে থাকে অনেকটা ঘনিষ্ট জনেরই মত। এমনি ভাবে ‘রবিউল ইসলামের’ বাবার সঙ্গে অনাহুত ভাবেই সাক্ষাৎ হল আমার। উনার জীবনের ঠিক অন্তিম লগ্নেই বলা যায়। কতক্ষণ? মনে হয় প্রায় এক ঘন্টা অবধী আলাপ হয়েছিল। সেই একান্ত পরিসরে ছিলাম, আমি রবিউল আর হাসান। আমার মনে পড়ে শুধু সালাম খানি জানিয়ে বসেই, তন্ময় হয়ে হৃদয়কে শান্ত রেখে শুধু উনার কথ শুনেছিলাম, আর মনে হয়েছিল। ক্ষনজন্মা এই ব্যক্তিত্ব, অবিস্বাস্য – অসাধারণ।
‘রবিউল ইসলামের বাবার জীবন দর্শনের অনেক কিছুই তুলে ধরব ভাবছি। পাঠক প্রশ্ন করতে পারে কিভাবে? উত্তর তার, আমি ক্ষণকাল তাকে দেখেছি ঠিকই, কিন্তু বাকি দেখা , শোনা, এবং বলা যে ‘রবিউল’ এর চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, মুখ দিয়ে এবং অন্তর চক্ষু দিয়ে, রবিউল ইসলামরে বেঁচে আছে, তার চোখ দিয়ে তাকে সরিয়ে তার বাবাকে দেখব। দেখব; তাঁর জীবন দর্শন, চিন্তা, চেতনা যতটুকু পারি আমার মতো করেই, আমি বিশ্লেষন করব আজ।
রবির, বাবার সঙ্গে পরিচয়ের কিছুদিন পর, শুনলাম হটাৎ করে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে এনায়েত পুর গবফরপধষ ঈড়ষষবমব এ ভর্তি করা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন খবর পাই, অসূস্থতার ভাল মন্দের পারদ, উঠছে-নামছে প্রতিক্ষনে। আমরা নিয়মিত সাথী সবাই উনার রোগ মুক্তির কামনা করতে থাকলাম। কয়েকদিন পর উনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। যেতে-যেতে, মনে-মনে বললেন;- “যেখানে যাহা কিছু ফসল জন্মাইয়াছি, তাহা কাটিয়া মাড়াই করিয়া গোলা বোঝাই করিয়া দিয়া এ মজুরি শেষ করিয়া চলিলাম” আমরা সবাই ব্যাথিত। ঠিক সেই একই দিন, যেটা না বললেই নয়, আমাদের নিয়মিত বসার সাথী ‘হাসান আহমেদ চিশতীর’ বাবা ‘কালের যাত্রার পথে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, এটাও বড় হৃদয়গ্রাহী, আমরা অবাক হয়ে রইলাম, অবাক পৃথিবীর দিকে। হৃদয়ের অবস্থা’টা ঠিক যেন বলা যায় “We nor swoon, nor uttered cry” (আমরা না মূর্ছা যেতে পারলাম, না চিৎকার করে কান্না)
উভয়ের অন্তিম যাত্রায় যে, অব্যক্ত কথাগুলো মনে ব্যাক্ত হচ্ছিল। ‘Robert Herrick’ এর কবিতার একটি শব্দকে বাদ দিয়ে
Fair dad we weep to see
You haste away so Soon
As yet the early rising Sun
Has not attained his noon
Stay Stay
Until the hasting day has run
বিধি কোনরূপ সাড়া দিলেন না, পুনঃ পুনঃ হৃদয়ে বাজছিল বেদনার সূর
‘কি গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ
সমস্ত পৃথিবী, চলিতেছি যতদূর শুনিতেছি
একমাত্র মর্মান্তিক সূর
যেতে আমি দেবোনা তোমায়
নিয়তি সে কথায় কোনরূপ কর্ণপাত করল না। আস্তে-আস্তে মনকে শান্তনার জায়গায় নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। মনে পড়ে গেল আমাদের পবিত্র কোরআনের দুটো আয়াত: “লি কাইলা, তাছাও, আলা মা ফাতাকুম”( (May not despair over Matters that pass you by)- তোমাদের কাছ থেকে যা কিছু হারিয়ে গেছে তারজন্য তোমরা আফসোস করোনা। (সূরা ‘হাদিদ’, আয়াত-২৩)।
পৃথিবীর কোন প্রানী’ ই চিরঞ্জীব হতে পারেনি। ‘ওয়ামা যা আল’না, লি বাশারিম মিন কাবলিকাল খুলদা ((I granted not to any man before thee permanent life). হে নবী আমি আপনার পূর্বে কোন মানব সন্তানকে অনন্ত জীবন দান করিনি (সূরা আল আম্বিয়া- আয়াত-৩৪)।
বন্ধন মুক্ত জীবনে সৃষ্টির অনুভূতি, এক অপূর্ব শিহরন জাগায় জীবনের প্রতিপলে, প্রতি ক্ষনে। সন্তানদের মধ্যেও সেটা সংক্রমিত হয়, তার দৃশ্যও কম নয়, বড়ই নান্দনিক বড়ই সুন্দর, সৃষ্টির আনন্দে উচ্ছসিত হয়, উদ্বেলিত হয়, মন প্রান। আর তাই বলা যায় ‘রবিউল ইসলামের’ পিতার অন্তরের-অন্তকরনে, সৃষ্টির সেই ভাবের অভিব্যক্তি টুকু। নজরুলের একটি কবিতার উক্তি থেকে:-
“আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে,
মোর মুখ হাঁসে, মোর চোখে হাঁসে, মোর টগবগিয়ে খুন হাঁসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে”
হ্যাঁ সত্যিই বলতে হয়, সার্থক জীবনের উপলদ্ধি অনেকটা এমনই। সমাপ্ত জীবনের এমনি ব্যক্তিত্বের চরণ ধূলার তলে, আমাদের মাথা, নত হোক শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে, মস্তক অবনত হোক, প্রার্থনা করি তাই বলি-
Give us an ideal parent
We will give you an ideal nation-
আদর্শ মাতা-পিতা না হলে, আদর্শ সন্তান হয় না, আর আদর্শ সন্তান না হলে, আদর্শ জাতি হয় না ।
এই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির জীবনের কিছুটা ব্যক্ত করতে গিয়েই তো এত কথা, এত অভিব্যক্তি সেটাতো তাঁর যোগ্য সন্তানদের জন্যই একেবারে পরিপূর্ন করে রেখে গেছেন গোটা পরিবার এবং সমাজকে এই জন্য আমরাও গর্বিত।
‘Wordsworth’ এর ভাষায় একটু ঘুরিয়ে বললে বলা যায়
“The Sounding Nurul Islam
Haunted us like a passion”
তাঁর চেতনা তাঁর বানী ও কথা আমাদের তাড়া করে ফেরে। ‘রবিউল ইসলামের’ সান্নিধ্যে তার বাবার প্রতিকৃতি প্রতি ধ্বনিত হয়।
Really the progeny of Nurul Islam are indedted to him for their life and also for knowledge.
এটা অবিশ^াস্য কেননা বেশির ভাগ সন্তানই বাবা-মার কাছে শুধু জন্মের জন্য ঋনী, আর জ্ঞানের জন্য ঋণী শিক্ষকের কাছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম, এক দিকে জন্ম আর দিকে প্রজ্ঞা, সত্যিই এক জায়গাতেই দূটোই পূর্ন । শিক্ষার পাঠশালা যে, গুরুগৃহ, আর এই গুরুগৃহেই স্বয়ং গুরজন পিতা, ভাবাই
Moral values’ ‘Soft skill’ যাই বলিনা এর শুরুটাই যে, গুরুগৃহ থেকে।
A Child can ask thousand questions
That the wisest man cannot answer. যায় না।
একটা শিশু জ্ঞানী মানুষকে হাজারো প্রশ্ন করতে পারে, কিন্তু সব উত্তর কি সে পায় ? বোধ করি ‘রবিউলের’ বাবার কাছে, এর একটু ব্যতিক্রম ছিল, যদি বলি ‘রবিউলের প্রায় প্রশ্নেরই উত্তর উনি দিয়ে গেছেন, তবে অতি শায়োক্তি হয় না। আমার এমনটা মনে হয়। আর তার ক্ষেত্রে বোধ করি, “আমার যা ছিল আমি সকলি দিতে পারিনি তোমাদের”।
পিতার বিদায়ের কথা মনে হতেই ব্যথিত হয়ে, হৃদয় মন। ঐ ‘Shakespeare’ এর বাণীর মতো।
“For there was never yet philosopher
That could endure the tooth ache patiently”
এমন কোন দার্শনিক নেই , যে তার দাঁতের ব্যাথা ধৈর্য্যের সাথে সহ্য করতে পারে। আমার দাঁত না হলে হৃদয় তো বটেই।
তাই বলি-“কি জানি কেন আর তেমন প্রফুল্ল হইতে পারি না, বহুকাল অব্যবহারে হৃদয়ের বীনাযন্ত্র বোধ করি বিকল হইয়া গিয়াছে, এখন সহস্র বার তার টানিয়া বাঁধিলেও ঢিলা হইয়া নমিয়া যায়, সে সূর আর কিছুতেই বাহির হয় না- ‘কবি গুরু’ যে সূর বাবা থাকতে বাজতো
তারপরও তিনিই আমাদের জীবনী শক্তি, আমাদের পথ চলার অনুপ্রেরণা, প্রজ্ঞার আঁধার।
যেটা আগেই বলেছি, যাঁর সান্নিধ্যে ক্ষণকালের জন্য আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। আর সেই সময় টুকুতে যে উপলব্ধি হয়েছিল, তা যদি বলি এমন সেটা অবশ্যই অত্যুক্তি হবে না। “এ বড় কৌতুহল, এ বড় রহস্য, এক টুকরো হীরক পাইলে, তাহাকে নানা ভাবে, নানা দিকে ফিরাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, আর এ একটি মানুষের মন, বড় অপূর্ব ইহাকে কতরকম করিয়া স্পর্শ করিয়া, সোহাগ করিয়া, আন্তরাল হইতে সম্মুখ হইতে, পাশর্^ হইতে দেখিতে হয়। “রবি ঠাকুর বাবার হৃদয়ের সেই স্ফটিক খন্ডটি, আমি দেখেছি, কোথাও কোন অস্পষ্টতা লক্ষ্য করি নাই, যা বলা যায় স্ব- মহিমায় উদ্ভাসীত।
‘রবি’ স্যারের বাবার অনেক কথাই শুনেছি তার মূখ থেকে। একজন আদর্শ পিতা হিসেবে সন্তানদের যে শিক্ষাগুলো দেওয়ার, সে সব কিছুই কানায়-কানায় পূর্ন করে গেছেন। আসলে এমন টাই তো চাই, কারন ঐ যে, ‘ডঃ আল্লামা ইকবাল’-
”দানা খাকমে মিলকার
গুলো ও গুলজার হোতা”।
অর্থাৎ, শস্যবীজ মাটিতে তার অস্থিত্বকে বিলীন করে সৃষ্টি করে যায়। সেটা গাছে পরিনত হয়ে শাখায়-পাতায়, ফুলে- ফলে বিকশিত হয়। আর তাই ধারাবহিক ভাবে চলতে থাকে, প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ত্যাগ করিতেই হইবে এবং ত্যাগের দ্বারাই আমারা লাভ করি, এটাই জগতের মর্মগত সত্য, ফুলকে পাপড়ী খগাতেই হয়। তবে ফল ধরে, ফলকে ঝড়ে পড়তেই হয় তবে গাছ হয়।
এই বিদগ্ধ জন সন্তানদের সাধারণ প্রকৃতির মতই বাড়ন্ত হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিলেন কোথাও বাধা দেন নাই, অর্থাৎ Let ছিল কিন্তু Let not উচ্চারন কম করেছেন। হয়ত এমন ভাবনা থেকেই, যাহা তাহারই, তাহা আপনিই তাহার নিকট ফিরিয়া আসিবে, মন্ত বড় গুন ছিল ভাল-মন্দ বুঝিয়ে দিতেন অর্থাৎ কোন কিছুর রসঢ়ধপঃ এর ব্যাপারটার ভাল খারাপ এর ব্যাখ্যা করে দিতেন। তিনি প্রচুর রূপে দিতে চেয়েছেন, আমরা প্রচুর রূপে নিতে পারি নাই।
“যে বেদনা হৃদয়কে অধিকার করে তা যেন নব আনন্দকে জন্ম দেবার বেদনা হয়”।
তিনি প্রচুর পরিমানে অধ্যাবসায়ে এ রত থাকতেন, তাঁর মুখ নিঃসৃত কিছু পবিত্র কোরআনের বাণী যে গুলো পারিবারিক জীবনে সন্তানদের জন্য শিক্ষনীয়।
১) ওয়া ওয়াছ ছাইনাল ইনসানা
বি ওয়ালি দাইহি
I have enjoined on man
Not to misbehave with them
(আমি মানুষকে পিতা- মাতার ব্যাপারে
তাঁদের সাথে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি।
সূরা- লোকমান-১৪
২। লানা তাল্লাহি আলাল কাজিবিন।
Invoke the curse of Allah
On those who lie
(তোমাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ
যারা মিথ্যা বলে। সূরা- আল ইমরান- ৫১
৩। ইন্নল্লা হা-লা ইউ হিব্বু, কুল্লা মুখতালিন ফাকুর
Allah loves not any arrogant boaster
উদ্বত অহংকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেনে না- লোকমান -১৮
৪। ওয়াক ছিদফী মাশহইকা
ওয়াক দুদ মিন ছাওতিকা
Moderate thy pace and lower thy voice
চলার সময় মধ্যম পন্থা এবং তোমার কন্ঠস্বর নীচু কর – লোকমান -১৯
৫। ইয়া আইয়্যূ হাল্লাজিনা আমানু
কুনু কাওয়া মিনা বিল কিছ্ত।
O You who believe
Stand out firmly for justice
তোমরা সর্বদাই ন্যায় বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকো।
যে শিক্ষা গুলো প্রত্যেক পরিবারের জন্যে অপরিহার্য
সেটাই তো Moral Values আর সেটাই তো Soft Skill:-
উপরোক্ত বাণীগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি ‘পবিত্র কোরআনের অনেক জ্ঞান রাখতেন, যে গুলো আমাদের পারিবারিক জীবনে ও সবার জন্য শিক্ষার আদর্শ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য আবশ্যক। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন মনিষিদের জীবন দর্শনের রচিত বইও অধ্যায়ন করতেন এবং তাদের জীবন দর্শনের কথাও তাঁর কাছে থেকে শোনা যেত। এদের মধ্যে প্রতিম যশা মৌলান রুমী, শেখ সাদী, ইমাম গাজ্জালি। এছাড়াও ‘হাদীছ’ সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানের পিপাসা কম ছিলনা, ‘রবীউলের’ বাবার সন্নিধ্যে এসে আমি ধন্য যে সাধক নিজের সমস্ত শক্তীকে বিক্ষিপ্ত না করে, ধারণ করতে পেরেছেন, সেইতো শান্ত স্বরূপ ইে তো সত্য।
কাড়িয়া লুটিয়া লওয়াকে আত্মাভিমান বলে মনে করেছেন, সেটা করেন নি তিনি। তিনি মুমিনের ন্যায় গৌরবে থাকিয়া স্বেচ্ছানিত উপহার নিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা শ্রদ্ধা যা নিতে গিয়ে হরন করতে হয়নি-হনন করতে হয়নি। একজন ব্যক্তিত্বের জন্য এই তো চাই, আর এ পাওয়া যে নিরষ্কুশ পাওয়া। সব দিয়েছেন, কি দেন নাই পরামর্শ, উপদেশ, অথর্, দেহ-মন উজাড় করে দিয়েছেন সমাজের সবার জন্য। তাই তো দেখা যায়, তার সান্নিধ্যে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মিলন-মেলা। শুর্চি, শুভ্র, চন্ডি পাঠ থেকে শুরু করে মূর্খ-শিক্ষিত, গাউজ-কুতুব, হাজি-গাজী, মৌলানা-মুফতি মুহাদ্দিছ-মুহাক্কিক, হাফেজ পীর ফকির-দরবেশ, বাউল, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, গরিব-দুঃখী সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কুলি-মুটে, মজুর , কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলে, আরও সমাজের বিভিন্ন পেশা জীবি মানুষের সমারোহ যা সত্যি বিরল। যা এমন ভাবে বলা যায় “গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহীয়ান”- নজরুল
অকাতরে দিয়েছেন দেওয়ার পেছনে, হয়তো ভাবনাটা এমন ছিলো:
What I give I have
What I spent I had
What I kept I lost
তাই তিনি রাখেননি নিয়েছেন সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যেখানে যে ভাবে দেওয়া যায় সেখানে সে ভাবেই দিয়েছেন। Didactical (উপদেশমূলক) এবং Dialectical (যুক্তিসিদ্ধভাবে) দূটো উপায়েই।
উনি নেই কিন্তু স্মৃতির পাতায় উনার জীবন্ত প্রতিছবি আমরা ধারণ করে রেখেছি।
উপরোক্ত কথাগুলো বলতে গেলে মনে পড়ে যায় পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত- “ইল্লাল্লাজিনা আমানু ওয়া আমিলুছ ছালিহাতি ওয়া তাওয়া ছাওবিল হাক্ক ওয়া তাওয়া ছাওবিছ ছব্রর ” অর্থাৎ (যারা বিশ্বাস করে নেক আমল করেছে, এবং অপরকে ভাল কাজের তাগিদ দিয়েছে এবং অপরকে ধৈর্য্য ধারণ করার উপদেশ দিয়েছে) সূরা- আল আছর-৩।
সমাজের জন্য যা কিছু করেছেন সেটা সমস্ত সংস্কারের উর্ধে উঠেই করেছেন জাত, ধর্ম, বর্ণ, সব একাকার করেই করেছেন, করেছেন সমস্ত সংকীনতার উর্ধে উঠে সাম্প্রদায়ীক চেতনার উর্ধে উঠে, দৃষ্টিকে মনকে, প্রসারিত করেছেন, ভালমন্দের পার্থক্য করতে বোধ শক্তির দরকার, সেই প্রজ্ঞা সেই গভীর জ্ঞানের অনুশীলন বিদ্যামান ছিল। ভার গম্ভীরতার মধ্যে একটা Healing Power ছিল (আরোগ্য শক্তি) সমাজের কোন স্তরের মানুষকে কোন ঔষধ প্রয়োগ করলে সমস্যা সংকট মোচন হয় স্রষ্ঠা সেই Spiritual (ইন্দ্রীয়) দ্বারা উপলদ্ধি করার ক্ষমাতা দিয়েছিলেন যা ছিল সবার কাছে এক অদ্ভুত বিষয় আর যে কারনে সবাই তার কাছে, এসে বিনায়াবনত হতেন। উনার মধ্যে Effortless Command ছিল আদেশ করতে গিয়ে কোন কষ্ট পেতে হতো না, সবাই কোন বিতর্ক ছাড়াই সেই আদেশ গুলোকে অল্মান চিত্তে গ্রহণ করে নিত অনেকটা মনে হয় সেই ক্ষমতা অর্জনের মতো সেই (ঝঢ়রৎরঃঁধষ) আধ্যাতিক ক্ষমতা যা এই ভাবে ভাবলে এবং বললে অত্যুক্তি হয় না।
When the self is in communion with the higher power, nature automatically obey
Without stress or strain this effortless command, over nature is called miraculous.
(যদি নিজের সত্তাকে বিশ্ব স্রষ্টার সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে প্রকৃতির যা কিছু আছে আদেশের ক্ষেত্র অবালীলক্রমে মানতে বাধ্য, আর এই মানতে যাওয়ার মধ্যে কষ্ট কেন থাকবে, মানুষও প্রকৃতির জীব, মানুষও মানতে বাধ্য, যে মানানোটা বিদগ্ধ গুনীজন ‘নুরল ইসলামের’ কাছেও সহজেই সম্ভব হয়েছে।)
আর এ বিষয় নিয়েই তো তাঁকে ভাবতে আমরা বাধ্য তাই মনে হয়, মূল্যবান ব্যাক্তিত্বকে এমন সস্তা করা নিজেদেরই ঠকানো। আমরা এ কারনেই ঠঁকি কারন বেঁচে থাকতে বুঝতে পারিনা, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা করতে পারি না। আমরা এখানেই ব্যর্থ এই জন্য নকল নিয়ে টানাটানি কারন ঐ যে, “আসলের চাইতে নকল অনেক বর্নাঢ্য ও রমনীয়”। ধীক আমাদের আমরা না বুঝেই পন্ডিত বনে যাই।
সত্যিকার অর্থে অনেক লিখেও সমাপ্ত হবে না। এই ক্ষণজন্মা প্রাণ পুরুষের কথা, দীর্ঘ জীবনের ইতিহাস কি? দুই-চার পাতায় সমাপ্ত হবার তা নিশ্চয়ই নয়। তাই বলি, ”পরিনামহীন ব্যর্থতার বোঝা অকারণে বহিয়া পড়িয়া থাকার চেয়ে সজীব ভাবে কিছু একটা হয়ে ওঠার চেষ্টা করা ভাল”- ’রবি ঠাকুর’- তিনি সজীব, চির সজীব।
তাঁর জীবনের আদর্শ, চেতনা, কর্ম, শিক্ষা আমাদের জীবনে অনুরনে রণিত হোক।
উপসংহারটা যদি এমনি ভাবে টানা যায়-
‘’ The fountain mingle with the river
And the river with the ocean
The minds of heaven mix forever
With a sweet emotion
Nothing in the world is single
All things by a law divine
In one spirit meet and mingle
Why not, I with thine”
(Loves philosophy of Shelley)
সেই একই সূর বাজে ‘Platonic’ ideal of love G “Every objects of nature whether animate or inanimate are linked together by a common bond of love. (প্রকৃতির প্রত্যেক বস্তুই জীবন্ত অথবা জীবনহীন একই ভালবাসার সূত্রে গাঁথা)
আমি বলব তিনি আমাদের মাঝেই প্রকাশিত, এই যে সম্মুখে, এই যে পার্শে^ এই যে অধোতে, এই যে উর্দ্বে। উনি যে, আমাদের ইন্দ্রিয় মনকে অহরাত্রি অধিকার করে আছেন। তাঁর সত্তা অমর ((Immortal) সূতরাং তিনি কোথায় প্রকাশমান, তা কি জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন আছে। না নেই। তিনি দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে অব্যহতি নিয়েছেন মাত্র। তাই স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে বলি। আমাদের যেন এমন বিভ্রান্তি না ঘটে, যে সর্বদাই-সর্বত্রই আপনাকে দেখেও না দেখি।
পরিশেষে বলব; আমাদের জীবন দর্শন হোক, আমরা নিতে আসিনি দিতে এসেছি, আমাদের পথ চলার দৃষ্টি ভঙ্গি তাঁদের মত হোক যারা বিদগ্ধ ব্যাক্তিত্ব, তাদের মতো। আসুন আমাদের প্রজন্মকে হাত ধরে চলার পথ সুগম করে দেই। এই নিরন্তর প্রচেষ্টাই আমাদের একমাত্র কাম্য হোক। আসুন আমরা সবাই ‘নূরুল ইসলামের ’ দেখানো পথে হাঁটি যে পথ শান্তির পথ, নিষ্কৃতির পথ, নিষ্কন্টক, নির্লীপ্ত সেই পথে।
সর্বশেষে বলি– Great Spirit deepest love- (হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রতি গভীর ভালবাসা)
“তোমার পতাকা যারে দাও
তারে বহিবারে দাও শকতি”
মুসলিম নিয়ম মোতাবেক কবরস্থ করার পর পবিত্র কোরআনের যে, আয়ত সবাই উচ্চারণ করে তা পূনরায় উচ্চারণ করে শেষ করি:- “মিনহা খালাকনাকুম ওয়া ফিহা নুয়ি-দু-কুম ওয়া মিনহা নুখ রিজুকুম তারাতান উখরা” (এই যমীন, তা থেকেই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি তাতেই আমি তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব এবং সব শেষে তা থেকেই আমি তোমাদের দ্বিতীয় বার বের করে আনব) সূরা ত্বহা-৫৫।
মা-বাবার জন্য আমরা প্রতি নামাজ অন্তে যে প্রার্থনাটি করি, সেটা বলেই সমাপ্ত করি। “রব্বির হাম-হুমা- কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা” সূরা বনী ইসরাইল- ২৪।
My Lord bestow on them Thy mercy
Even as they cherished me in chilidhood.
হে প্রভু তুমি ওদের (বাবা-মার) প্রতি দয়া কর যেমনি করে শৈশবে ওরা আমাকে লালন-পালন করেছিলেন।
লেখক : মো. নূরুল হক, ঈশ্বরদী, পাবনা।
ধন্যবাদ, সম্পাদক, দৈনিক আলাপ।
[…] শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,বেদনায় ‘’নুরুল ইসলা… […]